শেকড়ের ডানা
ইয়াসমিন হোসেন
বছর কয়েক পরের কথা। পালিয়ে যাওয়া মওলানার আর খোঁজ মেলেনি। হয়তো তিনি আজীবন গাঢাকা দিয়ে চলার পথ বেছে নিয়েছেন। এদিকে আহেদ আলী খুব ভয়ে ভয়ে দিন কাটালেও এখন সামলে উঠেছে।
ক’বছরে অনেক কিছুতে পরিবর্তনও এসেছে। সংসারে আরও নতুন মুখ এসেছে। কিন্তু আয়ের পথ হয়নি। বাধ্য হয়ে সে তার শহরের স্বল্পমূল্যে কেনা হিন্দুর তিনটি দোকান প্রথমে লিজে বিক্রি করেছে। তারপর টাকা নিয়ে পুরোটাই ছেড়ে দিয়েছে। সেই টাকায়ই ক’বছর কেটেছে। কিন্তু যে অভাব, তা আর দূর হয়নি। কারণ ঘরে বসে খেলে রাজকোষও শূন্য হয়ে যায়। আহেদেরও সেটাই হয়েছে। সবকিছুতে তার চাতুরি থাকায় কোন ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত সুবিধা হয়নি। লাভের অংক কেবলই দূর্বল হয়েছে।
আহেদের
এখন নতুন ভাবনা রহুলকে নিয়ে। ওকে কাজে লাগিয়ে টাকার মুখ দেখতে চায়। এরজন্য ধর্মীয় কিছু ফতোয়া বের করেছে। যদিও ওর বয়স আয় করার মত নয়। কিন্তু ফতোয়ার জোরে সেটাও যুক্তিযুক্ত করেছে। তাছাড়া উল্টোমুখে হাঁটা এই ছেলেটাকে লাগামে আনাটাও আহেদের জন্য জরুরি। ওকে সে কয়েক দফায় ক্লাস টপকিয়ে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত উঠিয়েছে। আসলে ওর এখন থাকার কথা ৪র্থ বা ৫ম শ্রেণীতে। নিজে শিক্ষকতা করে এবং এই সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় খাতিরের মানুষ থাকায় রাহুলের ক্লাস টপকানোতে সমস্যা হয়নি। আহেদের চিন্তা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করার কোন মানে নেই। সেখান থেকে সার্টিফিকেট পাওয়াটাই বড় কথা। সেটা কাজে লাগিয়ে আয়ের পথ হতে পারে। সে কারণেই আহেদ রাহুলকে নবমে উঠিয়েছে। এখন ম্যাট্রিকটা হলেই সার্টিফিকেট মিলে যাবে। আর সেটা দিয়েই ওকে টাকা আয়ের পথে নামাতে হবে।
রাহুল অবশ্য এমন কান্ডে খুব বিব্রত। এমনিতেই দেখতে ও একেবারেই ছোটখাটো, মগজে উপরের ক্লাশে পড়ার বিদ্যা নেই। সহপাঠিদের ছাড়িয়ে এভাবে লাফিয়ে উপরে উঠায় ওর বিড়ম্বনা কেবলই বেড়েছে। তাছাড়া স্কুলে কোন পড়াই ও পারে না। ক্লাশে ওর চেয়ে সবাই অনেক বড়। ওকে ছোট হয়ে থাকতে খুব কষ্ট হয়। স্কুলে সবাই ওকে পিচ্চি বলে ডাকে। বড়রা ইচ্ছে করেই ওকে জ্বলাতন করে। চড়-থাপ্পড় মেরে কথা বলে। বিষয়টা আহেদকে জানিয়ে কোন কাজ হয়নি। তার কথা, সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা। এটায় অংশ নিয়ে সার্টিফিকেট পেতে হবে।
আরেকটি
ঘটনা রাহুলকে খুব নিচু করে রেখেছে। ওকে স্কুলে আসতে হয়, কিন্তু আহেদ কোন বেতন দেয় না। নানান কৌশল করে, কাগজপত্র তৈরি করে- বিনাবেতনে পড়ার ব্যবস্থা করেছে। এরজন্য ওকে যেমন শিক্ষকদের কাছে ছোট হয়ে থাকতে হয়, সহপাঠিদের কাছ থেকেও বাজে কথা শুনতে হয়। লজ্জায় মরে যায় রাহুল। কিন্তু এসব আহেদকে জানিয়ে কোন কাজ হয় না। তার কথা- আর কদিন পরেই পরীক্ষা। সেটা হলেই সার্টিফিকেট মিলবে। এই বয়সে ওকে যখন উপরের ক্লাশে ভর্তি করা হয়, তখন স্কুলের হেড মাস্টারও ঘোরতর আপত্তি তুলেছিলেন। বলেছিলেন, এতো ছোট বয়সে এই ক্লাশে ওকে ভর্তি করা যাবে না। আহেদ তখন তার নানা কৌশলে তৈরি করা কাগজপত্র দেখিয়ে প্রমাণ করেছে- রাহুলের বয়স আছে। ও ম্যাট্রিকের উপযুক্ত। ‘বাট্কু’ বলে ওকে ছোটখাটো দেখায়। কাগজপত্র থাকায় তখন আর হেডমাস্টার কিছু করতে পারেননি। তবে তিনি সবই বুঝেছেন।
রাহুল খুব অস্বস্তি নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যায়। অনবরত শিক্ষকের গালমন্দ খায়। কঠিন কঠিন শাস্তি ভোগ করে। এভাবে অতিষ্ট হয়ে ওঠে ও। তাই একসময় ও স্কুল পালানো শুরু করে। এরজন্যও স্কুলে শাস্তির মাত্রা বেড়ে যায়, আহেদের হাতে পিটুনি খেতে হয়। সামনেই
ম্যাট্রিক পরীক্ষা। রাহুল ভেবে পায় না- ও কী পরীক্ষা দেবে! কিছুই তো জানে না! ওর এখন ক্লাস ফোর-ফাইভের বুদ্ধি। ও ম্যাট্রিক দেবে কিভাবে? এরইমধ্যে
ম্যাট্রিক পরীক্ষা এসে গেল। পুরো নকলের যুগ। পরীক্ষার হলে রাহুলের পাশে থেকে আহেদ নিজে সব উত্তর লিখে দিলো। নিজে শিক্ষক বলে অন্য শিক্ষকরা এতে তেমন একটা বাধা দেয়নি। তাছাড়া গোটা হল জুড়ে ছিল নকলের জয়জয়াকার। এভাবেই চললো পরীক্ষা। রাহুলেরও পরীক্ষা শেষ হলো।
আহেদ বসে থাকলো না। ফল বেরুনোর আগেই নিজের পরিচিত শিক্ষকরদের সহায়তায় একটি প্রাইমারি স্কুলে রাহুলকে ঢুকিয়ে দিলো। সেই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে ওকে দেখে অন্য শিক্ষকরা শুধু হো হো করে হাসলোই না, ক্লাসের ছেলে-মেয়েরাও মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। আর লজ্জায় মরতে লাগলো রাহুল। স্কুলের হেড মাস্টার দেখলেন, ওকে ফোর-ফাইভের কোন ক্লাসে পড়াতে দেওয়া যাবে না। তিনি দিলেন ‘ইনফেন’ ক্লাসের দায়িত্বে। সেই ক্লাসে ক্ষুদে ক্ষুদে বাচ্চারা পড়তো। তাদেরই পড়ানোর দায়িত্ব পড়লো রাহুলের উপর। কিন্তু
তাতেও ভাল বিপদে পড়তে হলো। বাচ্চারা ওকে মানতে চাইলো না। প্রথমদিন কোনমতে কেটে গেলেও দ্বিতীয় দিন বাচ্চারা ওর উপর চড়াও হওয়া শুরু করলো। কেউ খেলার জন্য ডাকলো, কেউ ওর ঘাড়ে চড়ে বসলো, ধমক দিলে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। মারামারি করতেও এলো। এসব কথা অন্য শিক্ষকদের বলতে পারছিল না রাহুল। কেবলই লজ্জায় মরছিল, আর মরছিল। বাচ্চাদেরই-বা দোষ কী! ওদের সমবয়সীদের কাছাকাছি কাউকে ওরা শিক্ষক বলে মানবেই বা কেন!
ম্যাট্রিকের ফল বের হলো। পরীক্ষায় রাহুল তৃতীয় হয়েছে। নিজে কিছুই না জেনে, না লিখে- এমন ফল পেয়ে রাহুলের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কারণ ওতো পরীক্ষাই দেয়নি। দিয়েছে ওর বাবা আহেদ। সুতরাং এতে ওর কোন প্রতিক্রিয়া হলো না।
আহেদ ভাবছিল, রাহুলের চাকরিটা পাকাপোক্ত হলে সে আবার নতুন বিয়ের জন্য মাঠে নামবে। সে জন্য আগাম যোগাযোগও শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু সরকারি এক সিদ্ধান্ত সব ভ-ুল করে দিলো। আগে সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল, স্কুলগুলোতে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। সেজন্য রাহুলকে চাকরিতে ঢুকিয়েছিল। কিন্তু সরকার হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদল করে ঘোষণা করেছে, আগের নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। স্বাভাবিক
ভাবেই মাথায় হাত পড়ে যায় আহেদের। ক্ষিপ্ত হয়ে সে পরিবারের উপর নতুন করে জুলুম নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো। পিটিয়ে স্ত্রীকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করলো। আর রাহুলকে পিটিয়ে বার বার বাড়িছাড়া করলো। বাধ্য হয়ে রাহুল কিছুদিন মামার বাড়ি, ফুপুর বাড়ি কাটালো। আহেত কখনও ওকে ধরে নিয়ে কারও বাড়িতে চাকর-বাকরের কাজ, কোন দোকানে ফাইফরমাস খাটার কাজ, গ্রামে ধান কাটার কাজ করানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু কোন কোনকিছুতেই ও যোগ্যতা দেখাতে পারছিল না। কিন্তু এভাবে জুলুম-অত্যাচারের মুখে রাহুলের জন্য বাড়িতে টেকা কঠিন হয়ে উঠেছিল। তখন ওর মাথায় কঠিন কিছু করার ভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগলো।
বেশ ক’মাস পর সফলতার মুখ দেখলো রাহুল। ও একটি বাম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুললো। এই দলের প্রকাশ্য আন্দোলন ছাড়াও ছিল গোপন আন্দোলন। গোপন আন্দোলনে ছিল সামরিক সাজ-সরঞ্জাম। দলের লক্ষ্য-আদর্শ ওরজন্য পুরো মিলে গেল। সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, ধর্ম ব্যবসা, অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছিল দলটি। এই দলের দীক্ষা পেয়ে রাহুল বুঝে ফেললো- ওর বাবার ভন্ডামি, দুর্র্নীতি, অনিয়ম আর জুলুমবাজির আদ্যপান্ত। ওর বাবা আহেদ তখন দুর্র্নীতিতে নেমে পড়েছিল পুরোপুরি। যে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতো, সেখানে আর্থিক অনিয়মের ভাগিদারও সে। সময়টি ছিল '৭৪ সাল। একে তো দেশে দুর্ভীক্ষাবস্থা, পাশাপাশি দেশজুড়ে চলছিল ভয়বহ রকমের দুর্নীতি, লুটপাট। এই সুযোগে সরকারবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী-মুসলিম লীগের লোক হয়েও মাদ্রাসাকে ব্যবহার করে কর্তৃপক্ষ শরীক হয়েছিল দুর্নীতিতে। বিদেশ থেকে তখন বিপুল রিলিফ আসছিল। গরীব নাগরিক আর শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলি করার জন্য মিলছিল নানান জিনিসপত্র। আহেদের মাদ্রাসায় আসছিল ওষুধপত্র, দুধ, খাদ্য, কম্বলসহ নানা জিনিসপত্র। এগুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে নামমাত্র বিলি করে সিংহভাগ জমা করা হচ্ছিল শিক্ষক-কর্তৃপক্ষের কাছে। পরে তা নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছিল। এই কারবারের অন্যতম একজন আহেদ আলী। ফলে রাহুলদের বাড়িতে আসছিল নানান খাদ্য সামগ্রী, ওষুধপত্র, দুধ। এগুলো কিছু নিজেরা ভোগ করে বাকিটা বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছিল। রাহুল কখনও কখনও এই দুর্নীতির ধর্মীয় ব্যাখ্যা দাবি করছিল। দুর্র্নীতির তীব্র প্রতিবাদ করছিল। তখনই ওকে বার বার বের করে দেওয়া হয় বাড়ি থেকে। এ রকম সময়ই রাজনৈতিক দল এবং দলের দীক্ষা ওকে দুর্দান্ত সাহসী করে তুললো। সশ্রস্ত্র শক্তি থাকায় অন্য কাউকে আর ভয় করার কিছু থাকলো না। রাহুল নিজেকে এবার মহাশক্তিশালী হিসেবে দেখতে পেল। ভাবলো এবারই তার ভ- বাবার সঙ্গে লড়াই জমবে। ------ চলবে ------