দার্জিলিং ভ্রমণ (পর্ব : সাত)
ইয়াসমিন হোসেন
রুমে ফিরে
আসার পর ভাবলাম, যে ঠান্ডা পড়েছেÑ আর একটু পর তো বাইরে পা
দেয়া যাবে না। এই সুযোগে ঘুরে এলে ভাল হতো। এতেকরে অসুস্থতা কমতে পারে।
স্বামীও তাই বলছিল।
বেরিয়ে এলাম বাইরে। হোটেলের ডান পাশেই গরম কাপড়ের শো
রুম। আমরা একনজর দেখে বামে চলে এলাম। অর্থাৎ যে
পথ দিয়ে আমরা বাসস্ট্যান্ড থেকে উঠে এসেছি সেই পথে নামলাম। নামতেও হাঁপিয়ে উঠলাম। এরপর রাস্তা পার হতেই দেখলাম নিচের দিকে চলে গেছে একই রকম, অর্থাৎ ৮/১০ তলা নিচু সিঁড়ি পথ। ওই পথের শেষে দোকানপাট-রাস্তা। নামলাম ওই পথে। দেখলাম একইভাবে এই রাস্তার পরেও নিচের দিকে খাঁড়া সিড়ি নেমে গেছে।
সেখানেও দোকানপাট-ঘরবাড়ি। বুঝলাম দিনভর যদি নামতেই থাকি তাহলে একই রকম দৃশ্য দেখবো। এভাবেই পাহাড়ের ঢাল থেকে নেমে গেছে মাইলে পর
মাইল জনপদ।
আমরা আর নামলাম না। এই পথ দিয়েই ডানের দিকে হাঁটলাম। ডান দিকটা উপরের দিকে উঠে গেছে।
সেই উপরেও মার্কেট-দোকানপাট। আমাদের দেশের রাজধানীর অলিগলি পথগুলোতে যেমন দোকানপাট-বাজার-ঘাট থাকেÑ এখানেও তেমন।
এসব দোকানপাটের মধ্যে মুদিখানা, স্টেশনারি, জামা-কাপরের দোকান, জুতার দোকান ইত্যাদিতে ঠাঁসা। এই ছোট্ট ছোট্ট পথ দিয়েই চলছে জিপ, কার, ট্যাক্সি। তবে কোন রিকশা বা ভ্যান, বাইসাইকেল বা ঠেলা গাড়ি নেই। না থাকার কারণ পরে বুঝলাম। কারণ এসব পথ তো উপরের দিকে উঠে যাওয়া বা নিচের দিকে খাঁড়া নেমে যাওয়া। এসব জায়গায় রিকশা-ভ্যান উঠতে-নামতে পারবে না। জিপ-কার-ট্যাক্সি উঠা-নামা করে ইঞ্জিনের জোড়ে। এই ফাঁকে কয়েকটা ছবি ওঠালাম ডিজিটাল ক্যামেরায়। পাশে একটা মাছ-মাংস-আলু-পটল-পেঁয়াজ-মরিচের বিরাট বাজার দেখলাম। এখানকার মেছো বাজার কেমনÑ দেখার জন্য ঢুকে পড়লাম। ঠাট্টা করে স্বামী বললো, তুমিই তো
বাজার করো, এখান থেকে আলু-পটল নিয়ে নাও না!
দেশে গিয়ে বলতে পারবে দার্জিলিং থেকে কিনেছো! ঘুরে ফিরে দেখলাম সব
আমাদের দেশের মতোই।
দাম-দর জিজ্ঞেস করলাম না। কারণ কেনার ইচ্ছে তো নেই। বাজারের আরেক পাশে ফাঁকা দেখা যাচ্ছিল। ওদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখি খোলা আকাশ। আর ওই আকাশ থেকে হুহু করে নেমে আসছে হিম শীতল ভারী বাতাস। অর্থাৎ ওটা ছিল বাজারের শেষ মাথা।
ওই শেষে কেবলই সাদা ধপধপে কুয়াশার মেঘে ঢাকা দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ। নিচের দিকে হয়তো সিঁড়ি নেমে গেছে।
কিন্তু যেভাবে ঠান্ডার নহর নেমে আসছিল তাতে এক মুহূর্ত দাঁড়ানোর ইচ্ছে থাকলো না। দৌঁড়ে পালানোর মতো করে ছুটলাম হোটেলের দিকে। কারণ ওই ঠান্ডার নহরই যে
আমাদের গ্রাস করতে ধেয়ে আসছেÑ তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। সুতরাং হোটেলে আশ্রয় নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে হোটেলে এসে মাথায় ভুত চাপলো ডানের যেদিকে ফটো ওঠাতে গিয়েছিলাম- সেদিকে অরেক দফা ভাল করে দেখে আসা যাক না! আর তো সময় পাবো না। সেইমতো পা
বাড়ালাম। খানিকটা এগিয়ে উপরের দিকে যেতেই ডান পাশে চোখে পড়লো বিরাট দর্শনীয় এলাকা। খেয়াল করতেই দেখলাম লেখা রয়েছে Big
Bazaar। নিচে ইংরেজিতেই আঞ্চলিক শব্দ রয়েছে যার মানে বুঝলাম না। সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হলো, আগেই শুনে এসেছিলাম
এই Big Bazaar সেই আকর্ষণীয় তালিকার অন্যতম।
সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়লাম। আসলে এটা হলো দার্জিলিংয়ের একটি ভাল শপিং মার্কেট। আমাদের দেশের বসুন্ধরার মতো, তবে অতো বিশাল নয়। এই Bazaar-এর কাপড়-জুতা-কসমেটিকস-ইলেকট্রিক শোরুম দেখার পর রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকলাম।
বিরাট রেস্টুরেন্ট, একেবারে হলরুমের মতো। কি খাবো ভাবছিলাম। কফির কথাটাই প্রথমে মাথায় এলো।
স্বামীও বললো, এতেকরে তোমার অসুস্থতার উপকার হবে।
অর্ডার দিতেই চলে এলো।
দু’কাপ কফি। পান করা শেষে যখন বিল এলো তখন চমকে উঠতে হলো। ভারতীয় টাকায় ২৬০ টাকা। এক কাপ কফি ১৩০ টাকা! বুঝলাম এখানে আর কিছু খেতে গেলে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এলাম। হোটেলের পথ
ধরলাম। তখনও পাসপোর্ট ফেরত পাইনি।
রিসিপশনে পাসপোর্ট নিতে এলাম।
আরও কাগজে সই
করতে হলো। তারপর ফেরত পেলাম।
এবার পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললাম। দুদিনের মধ্য এগুলো করতে হবে।
আসলে দুদিন নয়,
একদিনের মধ্যে সব
শেষ করতে হবে।
কারণ একদিন তো
হোটেলে উঠতেই গেল।
হাতে শুধু আগামীকাল।
তারপরের দিন সকালে হোটেল ছেড়ে শিলিগুড়ি ফিরবো। ভুটান যাবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু অসুস্থতার কারণে সেটা বাতিল করতে হয়েছে।
একটা বিষয় বুঝেছিÑ দার্জিলিং দেখার পর
আর ভুটানে দেখার কিছু থাকবে না। যা ভাল, যা দেখারÑ তা এখানেই বর্তমান। ম্যানেজার চার্ট ধরিয়ে দিলেন।
তাতে দার্জিলিংয়ের সব বেড়ানোর স্থান উল্লেখ করা হয়েছে। বললেন, আপনাদের সবকিছু দেখতে সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে আমাদের হোটেলের গাড়ি রিজার্ভ নেয়া। তাতে খরচ পড়বে দু’হাজার টাকা, আর ড্রাইভারকে দিতে হবে দেড়শ টাকা। সারাদিন ধরে এই
গাড়ি, অর্থাৎ প্রাইভেট কারে করে গোটা বেড়ানোর জায়গা দেখতে পারবেন। রিজার্ভ ছাড়া বেড়াতে গেলে অনেক ঝামেলায় পড়বেন, টাকাও খরচ হবে অনেক বেশি।
রাজী হয়ে গেলাম। টাকা পরিশোধ করলাম।
ম্যানেজার বললেন, টাইগারহিলে সূর্যদ্বয় দেখতে আপনাদের রাত সাড়ে তিনটায় উঠতে হবে। আমাদের বয়
সাড়ে তিনটা বা
চারটার দিকে ডেকে দেবে। সাড়ে চারটায় আপনাদের গাড়িতে উঠতে হবে। ড্রাইভার এসে যাবে।
আপনারা রুমে চলে যেতে পারেন, ড্রাইভারকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে আসবো। উনি আপনাদেরকে সারাদিন সঙ্গ দেবেন। আমার জ্বরের অবস্থা স্থিতিশীল। বাড়েনি, তবে কমেওনি।
স্থির হয়ে আছে, নাপা কাজ করছে।
রাত সাড়ে তিনটা/চারটায় ওঠার কথা শুনে ও একটু ঘাবড়ে যাচ্ছিলাম, বিশেষ করে অসুস্থতার কথা ভেবে। স্বামী আশ্বস্ত করলোÑ সব ঠিক হয়ে যাবে।
আধাঘণ্টা পর ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে এসে ম্যানেজার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আর বললেন, আমাদের কারটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। ওটার বদলে আপনাদের জন্য মারুতি মাইক্রোবাস দেয়া হয়েছে। বয় এসে চারটার দিকে ডেকে দেবে।
সাড়ে চারটার আগে ড্রাইভার এসে আপনাদের নিয়ে যাবে। যাবার সময় শীতের কাপড়-চোপড় নেবেন।
কারণ টাইগারহিলে বেশ ঠান্ডা। মনে মনে বললাম, আপনারা বলছেন বেশ ঠান্ডা, আমরা তো দেখছি এখানেই ঠান্ডার বাবাব বাবা জেঁকে বসেছে। ওখানে তো
তাহলে দাদার দাদা অপেক্ষা করছে। আমার অবস্থা আবার খারাপের দিকেই যাচ্ছিল। লেপ ও কম্বলের নিচে শুয়ে গরম করার চেষ্টা করেও ওর শীত যাচ্ছিল না। ওয়াটার ব্যাগ গরম করে দেয়ার পর কিছুটা কাজ হচ্ছিল। তবে বার বার থরথর করে কেঁপে উঠছিলাম। রুমে খাবার পরিবেশন করার জন্য রুম সার্ভিসকে বলেছিলাম। সাড়ে ৯টার দিকে তা এলো। ভাত-মাংস-সবজি, দুধ ইত্যাদি মিলিয়ে অনেক কিছু।
আমি মাংস খেলাম না। ভাত-তরকারি খাবার পর শুইয়ে পড়লাম। তার আগে স্বামী দুটো নাপা খাইয়ে দিলো। আবারও পানি গরম করে ছ্যাঁক দেয়ার ব্যবস্থা করলো। এক লেপ এবং কম্বলে দেখলাম ভেতরটা বেশ গরম হয়ে উঠেছে। রাতে কোন সমস্যা হবে বলে মনে হলো না। -------- চলবে --------