একাত্তরে পাবনার দিনপঞ্জী

 একাত্তরে পাবনার দিনপঞ্জী

-       ইয়াসমিন হোসেন

১৯৭১-এর পুরো মার্চ মাস পাবনা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে উত্তাল এক পর্যায়ে মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধে নামেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং পাবনাকে শত্রুমুক্ত করেন বাংলাদেশের ইতিহাসে এই মাসে এটাই ছিল যুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা প্রথম কোন জেলা বিজয় ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল পরের মাস এপ্রিলের ১০ তারিখ পর্যন্ত তারপর পাকিস্তানি বাহিনী পাবনা দখল করে নেয় তখন শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের মুক্তিযুদ্ধ এর জন্য যোদ্ধারা প্রতিবেশি দেশ ভারতে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন এবং পরে গেরিলা যুদ্ধে নামেন পুরো নয় মাস চলে যুদ্ধ

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গোটা জাতি পরিচালিত হচ্ছিল অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা নির্দেশ মত সে অনুযায়ী গর্বিত পাবনায় মার্চ মাসে উল্লেখযোগ্য যা যা ঘটেছিল, তার সারসংক্ষেপ দিনপঞ্জী আকারে তুলে ধরা হলো

মার্চ : দুপুরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে পূর্ব নির্ধারিত মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন প্রতিবাদে সারাদেশের মত পাবনার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন তিনি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোর টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতালের ডাক দেন পাবনার মানুষ তাঁর নির্দেশ আহ্বানে সারা দিয়ে আন্দোলনে নেমে পড়েন এই আন্দোলনে (শুধুমাত্র মুসলীম লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং পূর্ব বাঙলার কমিউনিস্ট পার্টি বা নকশাল ছাড়া) আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কোপন্থী), ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কোপন্থী) সহ পাবনার সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক পেশাজীবী সংগঠন একাত্ম থাকে

মার্চ : রাজধানী ঢাকায় ছাত্রগণজমায়েত থেকে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় মার্চপাস্ট করে সেই পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেওয়া হয় একইসঙ্গে সারাদেশে পতাকা উত্তোলনের জন্য আহ্বান জানানো হয়

পাবনায় এদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ  থাকে সন্ধ্যে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছাত্রদের উদ্যোগে মিছিল-সমাবেশ হয় সমাবেশগুলোতে শিল্পীরা জাগরণের গান পরিবেশন করেন ছাত্রদের সঙ্গে শ্রমিক, পেশাজীবী এবং বিভিন্ন সংগঠন পাড়ায় পাড়ায় একই কর্মসূচি পালন করে আন্দোলনের মূল যোগাযোগ কেন্দ্র হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ নেতা জাতীয় পরিষদ সদস্য আমজাদ হোসেন, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুর রব বগা মিয়াসহ বেশ কয়েকজন নেতার বাসভবন

মার্চ : রাজধানী ঢাকায় গণজমায়েত থেকে ছাত্র নেতারা স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন গণজমায়েত থেকেই সারাদেশেস্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার ডাক দেওয়া হয় সে অনুযায়ী পাবনায় পরিষদ গঠনের কাজ শুরু হয়

মার্চ : কেন্দ্রীয় নির্দেশ অনুযায়ী পাবনার ছাত্র নেতারা প্রতিটি স্কুল-কলেজেসংগ্রাম কমিটি গঠন শুরু করেন কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন ছাত্র নেতা আবদুস সাত্তার লালু, রফিকুল ইসলাম বকুল, ফজলুল হক মণ্টু, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, বেবী ইসলাম, আহমেদ করিম, রবিউল ইসলাম রবি প্রমুখ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগাম পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সাংগঠনিক যোগাযোগ সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন

পাবনার ছাত্র সংগ্রাম কমিটি জেলা স্কুলকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের স্থান নির্বাচন করে এখানেই প্রতিদিন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা হয় প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকেন এডওয়ার্ড কলেজের ব্যায়ামবীর মিস্টার ইস্ট পাকিস্তান খ্যাত জামিল আহমেদ, জেলা স্কুলের হেড মওলানা কসিম উদ্দিন আহমেদ, সুবল বাবু, জাহাঙ্গীর আলম সেলিম, ছাত্র নেতা আবদুস সাত্তার লালু, রফিকুল ইসলাম বকুল, ইকবাল হোসেন, বেবী ইসলাম, ফজলুল হক মণ্টু, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, সোহরাব উদ্দিন সোবা, আবদুল মান্নান গোরা, রবিউল ইসলাম রবি, রেজা কাদের খান, আমিনুল ইসলাম মুক্তা, জহুরুল ইসলাম বিশু, এবাদত আলী, মাসুম আহমেদ, সুবাস বাবু, হাবিবুর রহমান হাবিব, আবদুল হাই প্রমুখ তাঁরা শরীর চর্চা থেকে শুরু করে বোমা অস্ত্র তৈরির প্রশিক্ষণ দেন তারপর প্রশিক্ষিতদের নিয়ে গঠন করা হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী একইরকম প্রশিক্ষণ তৎপরতা পাড়া-মহল্লা গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এক পর্যায়ে এখানকার প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র নেতা ইকবাল হোসেন রফিকুল ইসলাম বকুল সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে রাজনৈতিক পক্ষেরহাই কমান্ড-এর পাশাপাশি ছাত্রদেরবিপ্লবী কমান্ড গঠন করেন তারা জেলা স্কুলকে সদর দফতর করেন এবং উপ-দফতর হিসেবে ছাত্র নেতাদের বাড়িগুলোকে ঠিক করেন শহরের ভেতর এরকম একটি প্রধান উপ-দফতর ছিল ডা. ইসহাকের বাড়ি এই বাড়ির ছেলে ইকবাল হোসেন, পাশের বাড়ির রফিকুল ইসলাম বকুল এবং ফজলুল হক মণ্টুর কারণে এটি ছিল বিপ্লবী কমান্ড পরিচালনার প্রাণকেন্দ্র উপ-দফতরটি ছিল যোগাযোগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল স্থান

মার্চ : অসহযোগ আন্দোলন, মিছিল-সমাবেশ এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ প্রস্ততির বিস্তৃতি ঘটে সর্বত্র গোটা পাবনা জেলা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে

মার্চ : বঙ্গবন্ধুর চুড়ান্ত নির্দেশনা পাবার জন্য সবাই উন্মুখ থাকেন মানুষ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের জন্য অপেক্ষা করেন

মার্চ : বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে প্রত্যেক জেলায় আন্দোলন পরিচালনার জন্যসংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন তিনিযার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেন নির্দেশের পর পাবনার গণআন্দোলন নতুন মাত্রা পায় নেতারা এই দিনইসংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন গঠিত এই কমিটির আহ্বায়ক হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএনএ আমজাদ হোসেন সদস্য থাকেন এমপিএ আমিন উদ্দিন, ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা, আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান মাহবুবুল হক, গোলাম আলী কাদেরী, আবদুর রব বগা মিয়া এবং ছাত্র প্রতিনিধি আবদুস সাত্তার লালু পরে সাত সদস্যের কমিটিতে পাবনার জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খান এবং পুলিশ সুপার আবদুল গাফ্ফারকে অর্ন্তভূক্ত করা হয় এই কমিটি হয় জেলার হাই কমান্ড কাজের সুবিধার্তে এই কমান্ডের অধীনে থানা পর্যায়েও সংগ্রাম কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয় পরে জেলা থানা পর্যায়ের গঠিত কমিটিগুলো স্ব স্ব জায়গারপ্রশাসন হিসেবে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে

মার্চ : জেলা হাই কমান্ডের অফিস হিসেবে এমএনএ আমজাদ হোসেনের নিজস্ব অফিসকক্ষকে ব্যবহার করা হয় পরে অফিস স্থানান্তর করা হয় পুরাতন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে

রকম সময়ে নকশালদের অন্তর্ঘাতি তৎপরতা বৃদ্ধি পায় তারা বিসিক শিল্প নগরী এলাকায় মোজাম্মেল হক নামে এক স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকারীকে শ্রেণীশত্রু হিসেবে গলা কেটে হত্যা করে বিসিকে অবস্থান করা ফিল্ড এক্সারসাইজের একদল পাকিস্তানি সৈন্য রাস্তা দিয়ে পটকা ফুটাতে ফুটাতে যাওয়া বরযাত্রীদের উপর গুলি বর্ষণ করে এতেকরে গণরোষ ফেটে পড়ে তখন হাই কমান্ড ওই মুহূর্তে পাল্টা আঘাত হানা থেকে বিক্ষুব্ধ মানুষকে বিরত করে

মার্চ : পাবনা জেলার ৯টি থানা অঞ্চলের সবগুলো স্থানে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধ প্রস্তুতি বিস্তৃত হয় বঙ্গবন্ধুর আহ্বান অনুযায়ী প্রতি অঞ্চল দূর্গে পরিণত হয়

১০ মার্চ : পাবনা শহর সদরসহ প্রায় সব জায়গায় ডামি রাইফেল, তীর-ধনুক এবং লাঠি-সরকি নিয়ে মানুষ তৈরি হন ক্ষেত্রে স্কাউট-ক্যাডেট, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ গোপনে সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়

১১ মার্চ : গণআন্দোলন এবং প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি আরও সু-সংগঠিত হয় হরতাল, বিক্ষোভ, অসহযোগের মাত্রাও জোরালো হয়

১২ মার্চ : যুবকদের হাতে বাঁশের লাঠি স্কাউটদের ব্যবহৃত ডামি রাইফেল নিয়ে যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে

১৩-১৭ মার্চ : গোটা পাবনাবাসী তৈরি হয়ে যান যুদ্ধের জন্য

১৮ মার্চ : সকালে বগুড়া থেকে দুইটি ট্রাক একটি জীপে করে পাকিস্তানি সামরিক অফিসার সেনারা নগরবাড়ি ঘাট দিয়ে ঢাকা যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিল তারা বাঘাবাড়ি ঘাট পার হওয়ার সময়ই বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে সেনারা বিক্ষুব্ধ মানুষকেশালে বানচোৎ বাঙাল বলে গালি দিলে চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ লাঠি-সোটা-ফালা-সরকি নিয়ে ধেয়ে আসেন এবং তাদেরকে অবরুদ্ধ করে ফেলেন ফেরি চালকও বিদ্রোহ করেন সবমিলিয়ে বেগতিক অবস্থা বুঝে পাকিস্তানি সেনারা আবার বগুড়ার পথে ফিরে যায়

আরেকটি ঘটনা ঘটে ঈশ্বরদী বিমান বন্দরে সেখানে অবস্থান করছিল একদল পাকিস্তানি সেনা বিক্ষুব্ধ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে করতে আক্রমনের উদ্যোগ নেন এখানেও বেগতিক অবস্থা দেখে সেনাদেরকে বিমান বন্দর থেকে উঠয়ে নেওয়া হয়

১৯-২২ মার্চ : যুদ্ধ প্রশিক্ষণে আগ্নেয়াস্ত্র জরুরি হয়ে ওঠে তখন রাজনৈতিক দলের হাই কমান্ড এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিপ্লবী কমান্ড জনগণের উদ্দেশ্যে কিছু নির্দেশ জারি করে সেই নির্দেশ মাইকিং করে প্রচার হয় তাতে বলা হয়, হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োজন তাই সবাইকে তাদের লাইসেন্স করা অস্ত্র-শস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য জমা দিতে হবে নির্দেশ জারির পর ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠকরা অস্ত্র সংগ্রহে মাঠে নেমে পড়েন

২৩ মার্চ : স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকার ডিজাইন আগেই পৌছে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিনিধির মাধ্যমে নমূনা ছবি এবং প্রচারপত্র পাঠানো হয়েছিল সেই পতাকার নমূনা অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে পতাকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয় এর একটি উদ্যোগ অনুযায়ী, নমূনাটি শহরের আদমজী গলির বগা দর্জির দোকানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে গোপনে অনেকগুলো পতাকা তৈরি করে তা ২২ মার্চের মধ্যে অনেকের হাতে পৌছে দেওয়া হয় ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস বিপ্লবী কমান্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এইদিন আনুষ্ঠানিকভাবে পাবনা টাউন হল ভবনে পতাকা উত্তোলন করা হবে সে অনুযায়ী, বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল করে ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উপস্থিত হতে বলা হয় এরই অংশ হিসেবে এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ছাত্র মিছিল বের করার সময় অনানুষ্ঠানিকভাবে কলেজে প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্র নেতা আবদুস সাত্তার লালু এরপর তাঁর নেতৃত্বে বিশাল মিছিল টাউন হল ময়দানে পৌছায় সেখানে বিপ্লবী কমান্ডের অন্যান্য নেতা যেমন রফিকুল ইসলাম বকুল, ইকবাল হোসেন, ফজলুল হক মণ্টু, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, বেবী ইসলাম, রবিউল ইসলাম রবি, জহুরুল ইসলাম বিশুসহ অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন বিপ্লবী কমান্ড নেতাদের নির্দেশমত তখন ছাত্র নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল টাউন হলের দেওয়াল ডিঙ্গিয়ে ছাদে উঠে পড়েন এবং হলের মাথায় থাকা পাকিস্তানি পতাকা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন

পরে কমান্ড নেতারা কালেকটরেট ভবনে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ফেলেন সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন কমান্ড নেতা বেবী ইসলাম এবং জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খান পুলিশ সুপার কার্যালয় এবং জেলা প্রশাসকের বাসভবনেও পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়

২৪ মার্চ : পাবনার সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়

২৫ মার্চ : গণআন্দোলন নির্মূল করতে ভোররাত থেকে রাজধানী ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একযোগে মেশিনগান, কামান, ট্যাংক সহযোগে হামলা করে একই লক্ষ্য নিয়ে মধ্যরাতে রাজশাহী থেকে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি পদাতিক সৈন্য পাবনায় এসে পৌঁছায় অবস্থান নেয় বিসিক শিল্প নগরীতে তারা ভোর থেকে মাইকে প্রচার চালিয়ে শহরে কারফিউ জারির কথা জানায় কাওকে ঘর থেকে বের হলেই গুলি করে হত্যার হুঁশিয়ারি দেয় মাইকে তারা বলে, ‘কারফিউ হো গিয়া হ্যায়, সব শালে ভাগ যাও ঘোষণার পর শহর নিথর নিঃশব্দ হয়ে পড়ে সকালের এমন অবস্থায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই পৌরসভার কৃষ্ণপুর এলাকায় হানাদারদের গুলিতে নিহত হন শুকুর আলী নামে এক ব্যক্তি

২৬ মার্চ : সন্ধ্যার আগে কৃষ্ণপুর গ্রামের কিছু মুসল্লি কারফিউ ভঙ্গ করে নিহত শুকুরের নামাজে জানাজার জন্য সমবেত হন সময় পাবনা পুলিশ লাইন দখলের জন্য বিসিক থেকে একদল পাকিস্তানি সেনা রওনা হয়েছিল তারা কৃষ্ণপুর এলাকায় প্রবেশ করামাত্র মানুষ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন পাকিস্তানি সেনারা তখন গুলি চালায় গুলিতে জানাজায় অংশ নেওয়া শেখ আবদুস সামাদ নিহত হন এবং আহত হন মওলানা ইব্রাহিম খলিল শেখ বদিউজ্জামান এতেকরে বিক্ষুব্ধ জনতা আরও বেপরোয়া হয়ে হানাদার বাহিনীকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা চালান এনিয়ে উভয়পক্ষে সংঘর্ষ বেধে যায় অবস্থা বেগতিক দেখে তখন পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে বিসিকের দিকে ফিরে যায়

ঘটনার আগেই জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খান এবং পুলিশ সুপার আবদুল গাফ্ফার পুলিশ লাইন রক্ষায় সবাইকে সমবেত করেছিলেন পুলিশ-ইপিআরসহ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত রাজনৈতিক, ছাত্র অন্যান্যরা পুলিশ লাইন মাঠে সমবেত হয়েছিলেন সময় জেলা প্রশাসক পুলিশ লাইনের ম্যাগজিন রুম খুলে সব অস্ত্র-শস্ত্র সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণ-যুবকদের হাতে তুলে দেন এইসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল, মার্ক ফোর রাইফেল, কারবাইনসহ গোলাবরুদ

আরেকদিকে পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন এমপিএ, রাধানগর তৃপ্তি নিলয় হোটেলের মালিক আবু সাঈদ তালুকদার, জেলা ভাসানী ন্যাপের সভাপতি ডা. অমলেন্দু কুমার দাক্ষী, দিলালপুরের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন মুক্তার, ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক শরিফুল হায়দার, আইনজীবী মুছা মোক্তার, এডরুক ওষুধ কারখানার মালিক আবদুল হামিদ খান, সিগারেট কোম্পানির এজেন্ট হাবিবুর রহমান, পৌরসভার ট্যাক্স কালেক্টর আবদুল খালেক তালুকদার, কাপড় ব্যবসায়ী সাহাজ উদ্দিন মুন্সিকফিল উদ্দিন আহম্মেদ, রাজেমসহ শতাধিক ব্যক্তিকে বিসিক ক্যাম্পে আটকে রেখে তাঁদের উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয় পরে তাঁদের অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয় গুলিবিদ্ধ হলেও তাঁদের মধ্যে মারা যাওয়ার ভান করে আবদুল খালেক তালুকদার বেঁচে থাকেন

রাতেই বিপ্লবী কমান্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ অভিযানে নেমে পড়ে মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, জহুরুল ইসলাম বিশু, বেবী ইসলাম, আহম্মেদ করিম, জাহাঙ্গীর আলম সেলিম, হেলাল, মকু, ফজলুল হক মণ্টু, হুমায়ন, শরিয়তসহ ১৭/১৮ জনের একটি দল শহরের হায়দার আলী ইঞ্জিনিয়ার, নুরু মিয়া, আমিনুল ইসলাম চৌবে ওরফে বিনু বাবু, বাস মালিক খলিল উদ্দিন এবং এডরুক লিমিটেডে গিয়ে বন্দুক, টুটুবোর রাইফেলসহ ১৯টি আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করেন

২৭ মার্চ : সারাদিন শহরের চারপাশে তরুণ যুবকদের সংগঠিত করা ছাড়াও লাইসেন্সকৃত বন্দুক সংগ্রহের  অভিযান চলে পাড়ায় পাড়ায় তরুণ-যুবকরা, লাঠি-ফালা, তীর-ধনুক এবং দেশি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের জন্য সংগঠিত হন রাতে পুলিশ লাইন রক্ষা এবং পাবনা শহর নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা তৈরির জন্য দ্বীপচরে আন্দোলনের নেতাদের নিয়ে বৈঠক ডাকা হয় বৈঠক ডাকেন হাই কমান্ডের প্রধান এমএনএ আমজাদ হোসেন, সদস্য এমপিএ আবদুর রব বগা মিয়া, আমিনুল ইসলাম বাদশা, জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খান, পুলিশ সুপার আবদুল গাফ্ফার, আরআই আবুল খায়ের, আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াজিউদ্দন খান, গোলাম আলী কাদেরী, বিপ্লবী কমান্ড নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল প্রমুখ বৈঠকে প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং এরসঙ্গে মানুষকেযার যা আছে তাই নিয়ে যুক্ত করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয় সে অনুযায়ী পুলিশ লাইন এবং তার আশপাশ দিয়ে পুলিশ ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ডিসি অফিস, পোস্ট অফিসসহ আশপাশে অবস্থান নিয়ে প্রস্তুত থাকেন

২৮ মার্চ : মধ্যরাতের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা শুরু করে তারা কনভয়, জীপ এবং ট্রাক বোঝাই হয়ে কমান্ডো স্টাইলে পুলিশ লাইন দখলে নামে কিন্তু তারা, আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের পরিকল্পিত অ্যাম্বুশে পড়ে যায় পুলিশ লাইন দখলের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল বিসিক থেকে কৃষ্ণপুর হয়ে অগ্রসর হয়েছিল আরেক দল টেলিফোন ভবনের দিক থেকে অগ্রসর হয়েছিল অ্যাম্বুশে পড়ে যাওয়া অবস্থায় প্রচ- গোলাগুলি চলে সময় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা পুলিশ লাইন রক্ষায় নজীরবিহীর বীরত্ব প্রদর্শন করেন যুদ্ধে শহীদ হন ২৯ জন পুলিশ সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে বিসিকে পথে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় কিছু সেনা টেলিফোন ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ভোরের মধ্যে রচিত হয় পুলিশ লাইন যুদ্ধের মহান বিজয়

পাশাপাশি এদিনই টেলিফোন ভবন, লস্করপুর, বালিয়াহালটে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে স্বাধীনতাকামী জনতার প্রচ- যুদ্ধ হয় যুদ্ধে দুপুরের মধ্যেই পাকিস্তানি হানাদাররা শোচনীয়ভাবে পরাজিত নিহত হয় লস্করপুরের যুদ্ধে শহীদ হন শামসুল আলম বুলবুল (যাঁর নামে শহীদ বুলবুল কলেজ) এদিন পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে থাকে কেবলমাত্র বিসিক শিল্প এলাকার অবস্থান

২৯ মার্চ : বিসিক মুক্ত করার জন্য সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষ যার যা আছে তাই নিয়ে চারদিকে অবস্থান নিতে থাকেন অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে হানাদাররা খবর পেয়ে সেনাদের উদ্ধারে রাজশাহী সেনানিবাস থেকে ছদ্মবেশে বেশ কয়েকটি ট্রাকে করে পাকিস্তানি সেনারা পাবনায় ঢোকে আকাশে জঙ্গি বিমানের ছত্রছায়ায় ট্রাকগুলি মানসিক হাসপাতাল এলাকা দিয়ে বিসিকে প্রবেশ করে এবং ঠিক একইভাবে আটকে পড়া সৈন্যদের নিয়ে মানসিক হাসপাতালের পাশ দিয়ে পাকশী অভিমুখে রওয়ানা হয় কিন্তু পথিমধ্যে তারা মুক্তিকামী জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান ছত্রছায়া দিয়ে হানাদারদের নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয় দাপুনিয়া, মাধপুর, দাশুড়িয়া হয়ে লালপুর পৌঁছানোর আগেই হানাদারদের সঙ্গে জনতার ১৭টি স্থানে যুদ্ধ হয় যুদ্ধে মেজর আসলামসহ দুই শতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় কিছু সৈন্য পালিয়েও যায় যুদ্ধে স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে শহীদ হন আটঘরিয়া থানার  দারোগা আবদুল জলিলসহ ১২ জন

বিসিক মুক্ত করার পর সেখানে আটক থাকা অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন এমপিএ, তৃপ্তি নিলয় হোটেলের মালিক আবু সাঈদ তালুকদার, ন্যাপের সভাপতি ডা. অমলেন্দু কুমার দাক্ষী, রাজেমসহ অজ্ঞাত অনেকের লাশ পাওয়া যায়

এদিনই দেশের মধ্যে পাবনা প্রথম হানাদার মুক্ত হয় ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা মুক্ত থাকে

[তথ্য সূত্র : পাবনার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বিভিন্ন লেখকের গ্রন্থ, মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাতকার এবং সংবাদপত্র]

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for Message

ঢাকা থেকে মালদ্বীপ ভ্রমণ- ৩ [Dhaka to Maldives Travel-3]

  ঢাকা থেকে মালদ্বীপ ভ্রমণ - ৩ [Dhaka to Maldives Travel-3] ঢাকা থেকে মালদ্বীপ ভ্রমণ- ৩ [Dhaka to Maldives Travel-3] : কোথাও নীল কোথাও স...