আগ্রাফোর্ট ভ্রমণ
সোনার তৈরি গম্বুজের সামনে লেখক |
কারুকার্যময় ভবন |
কারুকার্যময় ভবন |
কারুকার্যময় ভবন দর্শনে আমরা |
ফোর্টের ভেতর সাদা ও লাল কারুকার্যময় ভবন |
আগ্রা ফোর্টের ভেতর কারুকার্যময় সাদা পাথরের ভবন |
আগ্রা ফোর্টের ভেতর কারুকার্যময় ভবন |
আগ্রা ফোর্ট সবুজ চত্তরে লেখক |
আগ্রা ফোর্টের ভেতরে আরেকটি দৃশ্য |
আগ্রা ফোর্টের ভেতর সঙ্গী আবুল হোসেন খোকন |
আগ্রা ফোর্টের ভেতরে লেখক |
আগ্রা ফোর্টের ভেতরের দৃশ্য |
আগ্রা ফোর্টের প্রধান ফটকের আরেকটি দৃশ্য |
আগ্রা ফোর্টের প্রধান ফটক |
চলন্ত বাস থেকে নেওয়া আগ্রা ফোর্টের দৃশ্য |
আগ্রা ফোর্টের সন্মুখ চত্তরে লেখক |
- ইয়াসমিন হোসেন
দিল্লী। দিনটা ছিল ২০১৪ জুলাই মাসের ৯ তারিখ। ঘুম থেকে ভোররাত ৪টার দিকে উঠে প্রস্তুত হয়েছিলাম। হোটেলের বয় অবশ্য ঘুম ভাঙাতে এসেছিল এক ঘণ্টা পর ৫টায়। আমরা ৬টা বাজার ঠিক পনেরো মিনিট আগে তিনতলার রুম থেকে নেমে হোটেল কাউন্টারে চলে এলাম। ট্যুরিস্ট বাসের ছেলেটিও চলে এলো। সে আমাদের হাঁটিয়ে অলিগলি দিয়ে নিয়ে গেল বড় রাস্তার ধারে। সেখানেই আসবে ট্যুরিস্ট বাস।
আমরা অপেক্ষা করছি আর আগুনের মত গরমের উত্তাপ নিচ্ছি। এই ভোরবেলায়ও আবহাওয়া গণগণে চুলোর মতো। সামনের রাস্তায় খেটে খাওয়া মানুষজন ঠেলা সিএনজি রিকশা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফাঁকা সড়ক ক্রমেই সরগরম হয়ে উঠছে। তারপরেও আমাদের বাসের খবর নেই। আধাঘণ্টা চলে গেছে। যে ছেলেটি আমাদের নিয়ে এলো সে শুধু উঁকি দিয়ে বাস খুঁজে চলেছে, আর মোবাইলে ফোন করছে। জিজ্ঞেস করলে হিন্দিতে বলছে, এখনই চলে আসবে। এই ‘এখনটা’ যে কখন শেষ হবে বুঝতে পারছিলাম না। গরমে সেদ্ধ হতে আর ভাল লাগছিল না।
হোটেল থেকে যে ট্যুরিস্ট বাস ঠিক করে দেওয়া হয়েছে সেটা ‘গৌতম ট্যুরিস্ট সার্ভিস’-এর এসি লাক্সারি বাস। এই বাস আমাদের নিয়ে যাবে প্রথমে আগ্রা ফোর্ট, তারপর তাজমহল এবং শেষে রাধাকৃষ্ণ’র জন্মস্থান মাথুরায়। রাত ১০টার ভেতর দিল্লীতে ফেরত আসার কথা। কিন্তু যেভাবে যাত্রারম্ভেই বিলম্ব ঘটছে, তাতে কী হবে কে জানে! বুঝলাম, আমাদের দেশের মতো এখানেও সময়জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব আছে।
শেষ পর্যন্ত বাস এলো ৭টারও পরে। দ্রুত উঠে পড়লাম। আমাদের সিট ছিল মাঝামাঝির দিকে। যাত্রীদের বেশিরভাগই ইন্ডিয়ান। এক-দুজনকে মনে হলো পশ্চিমা দেশের। যাত্রী উঠাতেও যথেষ্ট সময় ব্যয় হলো। তারপরও বাস চলছে আর রাস্তার বিভিন্নস্থান থেকে যাত্রী তুলছে। এরা সবাই আগে থেকে বুকিং পাওয়া যাত্রী। হয়তো রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় তাদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। সেইমতো তারা দাঁড়িয়েছিল, আর খুঁজে খুঁজে মাছ ধরার মতো ট্যুরিস্ট বাস তাদের তুলে নিচ্ছিলো। এভাবে কাজ সারতে গিয়ে দিল্লী শহর পেরুতেই চলে গেল আরও প্রায় দেড় ঘণ্টা মতো। এরপর বাস ছুটলো যাত্রা পথে।
দিল্লী এবং শহরতলীর নানা দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছি। ভাবছি, আমাদের বাংলাদেশ খারাপ কীসে? সেই একই দৃশ্য, একই জীবনযাত্রা। রাস্তার ধারে দোকানপাট আমাদের দেশের মতোই। মানুষজন চলছে আমাদের দেশের চেহারা নিয়েই। তফাৎ কোথায়? কোন তফাৎ নেই। দিল্লী-ঢাকা, ভারত-বাংলাদেশ কোন তফাৎ নেই। অনেক কিছু না দেখে না জেনে আমরা অন্য জায়গাগুলোকে কতোনা স্বপ্নের মতো করে দেখি! আসলে সব একই।
আমরা সকালে নাস্তা করে বেরোইনি। চলতে চলতে ১১টা মতো বেজে গেছে। ক্ষুধায় পেট জ্বলছিল। আমাদের মতো অন্য যাত্রীরাও যে একই সমস্যায় ভূগছিল- তা তাদের হাবভাবে বেশ বোঝা যাচ্ছিলো। ভাবছিলাম, বাসে যদি নাস্তার ব্যবস্থাটা থাকতো- তাহলে কতো না ভাল হতো! এসব যখন ভাবছিলাম তখনই হঠাৎ বাস রাস্তার ধারের একটা ফাঁকা জায়গায় প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল বসানো খোলা হোটেলের সামনে থেমে পড়লো। সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাসের সবাইকে আধাঘণ্টার জন্য নাস্তার সময় দেওয়া হলো। আমরা দ্রুত নেমে বসার আয়োজন করলাম। পাশে টয়লেটের ব্যবস্থা থাকলেও পানি নেই। এই মেঠো হোটেল থেকে পানির বোতল বাড়তি দামে কিনে কাজ সাড়তে হবে। সবাইকেই তাই করতে হলো। তারপর খাবার পালা।
আমরা গণটেবিলে বসার পর খাবার আসতে লাগলো। তিনটে করে পাতলা পরোটা আর সবজি। সঙ্গে ঝোলের মতো বিস্বাদ ডাল। কিন্তু পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলতে থাকায় গোগ্রাসে এসবই চালান করতে হলো। কোনকিছুই স্বাদের নয়। কেমন যেন এক ধরনের পানসে গন্ধে ভরা। যাইহোক প্রথমে ভেবেছিলাম এটা বোধহয় ট্যুরিস্ট কোম্পানির নিজস্ব খরচে দেওয়া নাস্তা। কিন্তু পরে দেখি, না- এটা যার যার পয়সায় খেতে হবে। ভাল কথা, যখন দাম হাঁকা হলো তখন মাথা ঘুরে যাবার অবস্থা। আধাসেদ্ধ পাতলা তিন পরোটার দাম কতোই-বা হবে? বড়জোড় ১৫টাকা। না হয় ধরলাম ৩০ টাকা। আর সবজি-ডাল মিলে আর ৩০ টাকা। ৫০ থেকে ৬০ টাকার বেশি কোন মতেই হবার কথা নয়। অথচ আমাদের কাছে হাঁকা হলো ৩শ টাকা করে। যাত্রীদের সবাই মাথায় হাত দেওয়ার অবস্থা! ইন্ডিয়ান ৩শ টাকা মানে বাংলাদেশি প্রায় ৫শ টাকা। জনপ্রতি এই টাকা মানে বিরাট ব্যাপার! কিন্তু কি করা! খেয়ে যখন ফেলা হয়েছে তখন তো আর না দিয়ে উপায় নেই। সব ট্যুরিস্টকেই তাই-ই দিতে হলো। পানির বোতলের বাড়তি দাম আলাদা করে রাখলো।
বাস ছুটলো। চলছিল একেবারেই ঢিমেতালে। যেন কোন তাড়া নেই। আমরা তো জানি না কতো দূর, কতো সময় লাগবে? তবে বাসের গতি আমাদের বেশ বিরক্ত করছিল। বেলা যখন প্রায় ২টা মতো, তখন এক জায়গায় বাস থামলো। উঠলো ট্যুরিস্ট কোম্পানির গাইড। তিনি ঢুকেই হিন্দিতে নিজের পরিচয় দিয়ে আগ্রায় পৌঁছার কথা জানান দিলেন। এরপর বক্তৃতা শুরু করলেন। বর্ণনা করতে লাগলেন আগ্রাফোর্টের ইতিহাস। বললেন, এটা তৈরি করেন মোঘল সম্রাট আকবর। প্রায় সাড়ে চারশ বছর আগে, অর্থাৎ ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করা এই ফোর্টে রয়েছে সাদা মার্বেল পাথরের মতি মসজিদ, রয়েছে সম্রাটদের তৈরি দিওয়ান-ই-আম, দিওয়ান-ই-খাস, সম্রাট জাহাঙ্গীর প্যালেস, তার খাসমহল, শীষ মহল, সামান ব্রুজ। এই ফোর্টের দৈর্ঘ্য সোয়া দুই কিলোমিটার, এর তাবৎ দেওয়াল এবং কাঠামো তৈরি হয়েছে রেড পাথর ও কংক্রিটে। ভবনগুলোর মধ্যে আছে সাদা পাথর, মার্বেল পাথর, রেড স্টোন এবং গোল্ড স্টোনের। এর দেওয়াল ৯ মিটার মোটা এবং ১০ মিটার মাটির গভীরে প্রথিত। তার ভাষ্য অনুযায়ী, এই আগ্রা ফোর্ট আগা-গোড়াই ছিল- যখন যারা রাজত্ব করেছেন তাদের সামরিক দূর্গ। এখন এটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর দূর্গ। তবে জনসাধারণের দেখার জন্য কিছু অংশ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। ট্যুরিস্টরা এই উন্মুক্ত অংশই দেখতে পারেন। বাকি অংশে প্রবেশের সুযোগ নেই। আমাদেরকে এই উন্মুক্ত অংশই দেখানো হবে।
বক্তৃতার শেষ পর্বে এসে গাইড জানালেন, এই ফোর্ট দেখতে ১০টাকার টিকেট কাটতে হবে। এ সুযোগ শুধু ইন্ডিয়ানদের জন্য। এর বাইরে অন্য দেশের দর্শনার্থীদের জন্য টিকেটের দাম ৪শ টাকা করে। সবাইকে এই হিসেবে টিকেটের দাম দিয়ে দিতে বলা হলো।
স্বামীর সঙ্গে ফিসফিস করা শুরু করলাম। আমরা তো বাংলাদেশি। তাহলে কি আমাদের চারশ চারশ করে আটশ টাকায় টিকেট কাটতে হবে? আটশ টাকা মানে অনেক টাকা। কী করি! ভুলটা করে বসলাম তখনই। গাইডকে ডেকে জানালাম আমরা বাংলাদেশি, আমাদেরকে কি এতো টাকা দিতে হবে? চতুর গাইড বেশ আফসোস করলেন। শেষে আস্তে করে হিন্দিতে বললেন, ‘আমাকে দুজন মিলে ৬শ টাকা দিন, আমি দুটো টিকেট করে দেবো। এতে আপনাদের ২শ টাকা সেফ হবে।’ প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, ‘এখানকার কর্নেল এবং গেটম্যানকে ম্যানেজ করতে টাকা দিতে হয়। তাদের সাহায্য নিয়েই আপনাদের ঢুকিয়ে দেবো, কোন অনুবিধা হবে না।’ এই বলে তিনি আমাদের কাছ থেকে ৬শ টাকাসহ পাসপোর্ট নিয়ে নিলেন। পরে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন ১০টাকা দামের দুটো টিকেট। বললেন, ‘কোন কথা না বলে ঢুকে যাবেন’।
পরে বুঝতে পেরেছিলাম, গোটা টাকাটাই গাইড মেরে দিয়েছেন। আমাদের চেহারায় তো বাংলাদেশি লেখা নেই। উনি আমাদের ইন্ডিয়ান বলে ১০ টাকা ১০ টাকা মোট ২০ টাকার টিকেট ধরিয়ে দিয়ে কাজ হাসিল করেছেন। ভেতরে ঢুকতে ‘আমরা ইন্ডিয়ান না বাংলাদেশি’ এসব প্রশ্নই ছিল না। দিব্বি বিশাল লাল দেওয়ালের গেট দিয়ে আগ্রা ফোর্টে ঢুকে পড়লাম। গেটে অবশ্য সামরিক বাহিনীর লোকেরা যন্ত্রপাতি দিয়ে ভালমতো চেক করে নিয়েছিল। ক্যামেরা-মোবাইল ছাড়া অন্যকোন ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি বহন নিষিদ্ধ। থাকলে সেগুলো রেখে যেতে হচ্ছিল।
ও হ্যাঁ, বলে নেওয়া ভাল- এখানে গরম কিন্তু দিল্লীর চাইতেও বেশি। সম্ভবত সাদা পাথর, মার্বেল পাথর আর নাম না জানা নানান কারুকার্যের পাথরে সূর্য্যরে তাপ বিকিরণ হয়ে আবহাওয়ার তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও উপরে তাপমাত্রা চলে গেছে কিনা কে বলবে! আমাদের মাথার ঘিলু যেন গলে যাচ্ছিল। শরীর অবশ হয়ে নুইয়ে পড়ছিল। কিন্তু করার তো কিছু নেই। যতো দ্রুত সম্ভব ঘুরেফিরে বেরিয়ে আসতে হবে। অবশ্য ইন্ডিয়ানরা বোধহয় এই গরমে অভ্যস্ত। তাদেরকে আমাদের মতো খারাপ অবস্থায় দেখাচ্ছিল না।
আকাশচুম্বি দেওয়াল, যা মহামূল্যবান পাথরে নানা কারুকার্যে খোদাই করা- আমরা এসব পেরুচ্ছিলাম। কোথাও লাল টকটকে চোখ ধাধানো কারুকাজের দেওয়াল, কোথাও নীল, কোথাও হলুদ, কোথা বেগুনি, আবার কোথাও-বা সোনালী। গাইড একটি ভবন দেখিয়ে বললো, এটার ভেতরের দিকটা গোটাই সোনার পাথর দিয়ে তৈরি। ভবনটিও সোনার। তার উপরে গম্বুজ রয়েছে সেটাও গোল্ড। তবে ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। আমরা বাইরে থেকে সোনার তৈরি ভবন দেখলাম।
দীর্ঘ এলাকার পুরোটা ঘোরা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। কারণ একটাই, প্রচন্ড গরম। শীতকাল হলে মন ভরে সব দেখা যেতো। বেশ কিছু এলাকা এরইমধ্যে ঘুরেফিরে তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছিলো। দেখলাম আমাদের সঙ্গীদের অনেকে দৌড়ে যাচ্ছে একটা ভবনের দিকে। হাতে পানির বোতল। আমাদের সঙ্গেও বোতল ছিল। ছুটলাম সেদিকে। গিয়েই পাওয়া গেল প্রাণরক্ষার পানি। বিরাট ট্যাঙ্কি বসানো আছে, আছে অনেকগুলো ট্যাপকল। ওই ট্যাপকল ছাড়লেই বেরুচ্ছে প্রসেস করা হীম শীতল ঠান্ডা পানি। আমরা গরম দেহে হীমশীতল পানি ঢোকালাম। কিন্তু ফল যে ভাল হবে না সেটা আগে বুঝিনি। দেহ ওই ঠান্ডা সহ্য করার অবস্থায় ছিল না। বুক আটকে দম বন্ধ হবার অবস্থা হলো। অবশ্য কিছুক্ষণের ভেতর আয়ত্বে এলো শরীর।
আমাদের আরও বেশ কিছু এলাকা ঘুরিয়ে উঠানো হলো ট্যুরিস্ট বাসে। এখানে এসির বাতাসে শরীর অনেকটা ঠিক হতে লাগলো। কিন্তু গরমের প্রচন্ডতা এতোই যে- ফুল স্পিডের এসিতেও আমরা সবাই ঘামছিলাম।
এবার আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো একটি আধুনিক হোটেলে। সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থা। জনপ্রতি ৯০টাকা। ইচ্ছেমত খাওয়া যাবে মাছ, মাংস আর সবজি। আমরা বেশ মনের সুখেই দুপুরের খাওয়াটা সারতে পারলাম। এরপর থাকলো তাজমহল দেখার পালা।