দার্জিলিং ভ্রমণ (পর্ব : ছয়)
ইয়াসমিন হোসেন
জিপ থেকে নামতেই শরীরের উপর ঝপ করে ভয়াল শীত ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাড়াতাড়ি লাগেজ নামানোর কাজে হাত বাড়ালাম।
জিপের হেলপার ওগুলো নামিয়ে দিলো। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছি সেটা বাস স্ট্যান্ড। কিন্তু আমাদের দেশের মতো সমতল নয়। দোকানপাটের সামনে গড়ানো সড়ক পথ। সামনের দিকটা খাঁড়া উঁচু হয়ে বামের দিকে বেঁকে গেছে।
পেছনের দিকটা খাঁড়া নিচু হয়ে ডানের দিকে বাঁক নিয়েছে। হোটেলের কথা মনে করতেই পাশ থেকে একজন এসে হিন্দিতে প্রশ্ন করলেন হোটেল চাই কিনা? আমরা মাথা নাড়তেই তিনি তার হোটেলের বর্ণনা দিলেন। আমাদেরকে বাংলাভাষী বুঝতে পেরে তিনিও বাংলায় বললেন, ১২শ থেকে ৩
হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়ার রুম আছে।
আমাদেরকে পছন্দ করে ভাড়া ঠিক করার অনুরোধ জানালেন। আসলে যে ব্যক্তিটি কথা বলছিলেন তিনি একটি হোটেলের ম্যানেজার। রুম পছন্দ করার জন্য তিনি ডাকলেন। আমরা তার পিছু নিলাম। রাস্তা পার হয়ে একেবারে পাহাড়ের গা বেয়ে মাথা বরাবর খাড়া উপরের দিকে সিঁড়ি। আমাদের দেশের অন্তত ৬ তলা পর্যন্ত ওঠার পর বিরতি নেবার জন্য একটু জায়গা।
ঠিক আরও অতোটুকু উঠতে হবে। লাগেজ নিয়ে তো
দুজনই হাঁপিয়ে গেছি।
আমরা এভাবে হাঁপিয়ে উঠলেও ওই ম্যানেজার দিব্বি একেবারে উপরের মাথায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। এরপর বেশ সময় নিয়ে উপরে উঠলাম।
সিঁড়ির মাথার উপরেই হোটেল। নাম ‘হোটেল স্বাতি’, ইংরেজিতে Hotel Swati। ৬৩ লাডেন লা রোড, দার্জিলিং। রুম দেখতে বেরুলাম। কয়েকটি রুম দেখে ৩০৬ নম্বরের বড়সড় ডাবল রুম পছন্দ করলাম। এই রুম থেকে দু’ধারের জানালা দিয়ে পাহাড়ি দার্জিলিং দেখা যাবে।
রুমে টিভি আছে, সোফাসেট আছে, বড় গোসলখানা আছে। প্রশ্ন করলাম রুম হিটার আছে কিনা? ম্যানেজার বললেন, না নেই, তবে গিজার আছে। গিজার কি জিনিস প্রশ্ন করতেই উনি বললেন, গরম জলের ব্যবস্থা। সুইচ দিয়ে রাখলেই ১০ মিনিটের মধ্যে গরম জল পাবেন।
আমরা তখন বেশ ক্লান্ত ছিলাম। প্রচন্ড শীতে টিকতে পারছিলাম না। হয়তো তখন ৬
ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা ছিল, যাতে আমরা মোটেও অভ্যস্ত নই। আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।
হঠাৎই জ্বরে টিকতে পারছিলাম না। অগত্যা এই ৩০৬ নম্বর রুমই দু’দিনের জন্য ঠিক করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ম্যানেজারের কাউন্টারে এসে ভাড়া ঠিক করায় মনোযোগ দিলাম। ম্যানেজার বললেন Feeding &
Loading, অর্থাৎ থাকা-খাওয়া এবং ট্যাক্সসহ ২ হাজার ৬শ টাকা দিতে হবে।
আপত্তি করলাম। শেষ পর্যন্ত রফা হলো, দু’দিনে সবসহ ২
হাজার ৪শ ২০ টাকা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দেড়টা বাজে।
তারমানে ভর দুপুর। খাবার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই জানানো
হলো, ২টার দিকে দুপুরের খাবার দেয়া হবে। এছাড়া মেনুতে বিকেলের চা-নাস্তা, রাতে ডিনার, ভোর বেলা বেড-টি, সকালে নাস্তার ব্যবস্থা রয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবার পর ম্যানেজার জেরক্স করার জন্য পাসপোর্ট চাইলেন। তিনি জানালেন লেখালেখির কাজ শেষ হলেই পাসপোর্ট পৌছে দেয়া হবে। আমাদের রুমে ঢুকতেই শীত যেন আরও জোরদার হয়ে আঁকড়ে ধরলো।
প্রথম দেখে রুমটা যতো ভাল মনে হচ্ছিল, এখন তা
মনে হলো না। হয়তো প্রচন্ড শীতের প্রভাব রুমের ভেতর ভর করেছিল। আমাদের দেশে প্রচন্ড শীতে রুম যখন ঠান্ডা বরফ হয়ে ওঠে, তখন মনে হয় রুমটাই বুঝি ঠান্ডা ছড়াচ্ছে। এখানেও সেটাই মনে হতে লাগলো।
থরথর করে কাঁপছিলাম। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু পানিতে হাত দেবার মতো কোন ইচ্ছেই হলো না। বাথরুমে গিয়ে মনে হলো বরফের ময়দান। বড় রুম। জানালা খোলা ছিল বলে হুহু করে হিমশীতল বাতাস ঢুকছিল। তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলাম। তাতে ঠান্ডা কমলো বলে মনে হলো না। মূল রুমের জানালার মোটা পর্দা টেনে দিলাম। টিভি ছেড়ে দিয়ে দু’জনই ফ্রেশ হওয়ার চেষ্টা করলাম। বেডে একটা লেপ এবং একটা মোটা কম্বল ছিল। লেপটা সেরকম পরিস্কার নয়। ম্যানেজারকে ডেকে পাল্টে দিতে বললাম। আরও বললাম, এ দিয়ে হয়তো আমরা শীত মোকাবেলা করতে পারবো না। আরও কম্বল লাগবে। তিনি বললেন, যদি লাগে দেয়া হবে। আর লেপ এখনই পাল্টে দেয়া হচ্ছে। দু’জন ফ্রেশ হওয়ার পর লেপ-কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লাম।
এরইমধ্যে লেপ পাল্টে দেয়া হয়েছিল। আমার গায়ে তখনও প্রচন্ড জ্বর। স্বামী তাড়াতাড়ি ইলেকট্রিক ওয়াটার ব্যাগ বের করে চার্জে ঢোকালো। কম্বলের তলায় কয়েক মিনিটের মধ্যে গরম হয়ে উঠতেই ওয়াটার ব্যাগের ছ্যাঁকা নিলাম। তাতে সামান্য
কাজ হলেও জ্বর কমছিল না। বেশ চিন্তিই হয়ে উঠলাম। কারণ যে
প্রচন্ড ঠান্ডাÑ এই অবস্থায় কোথায় যাবো? কোথায় ডাক্তার খুঁজবো? পরিচিত জায়গা তো
নয়! আমার কাছে ওষুধপত্র ছিল। কিন্তু শূন্য পেটে ওগুলো দিতে চাইছিলাম না। ভাবলাম দুপুরের খাওয়ার সময় নাপা ট্যাবলেট খেয়ে নেবো।
তবে তখন পর্যন্ত হোটেলের দেয়া বিলিং লিস্টে চোখ বোলাইনি বলে দেখতে পাইনিÑ এ হোটেলে ডাক্তার থেকে শুরু করে সব ধরণের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ম্যানেজার ছুটতে ছুটতে এসে দরজায় টোকালেন।
খুলতেই বললেন, ‘আপনাদের ছবি লাগবে, আপনারা সাংবাদিক, এখানকার প্রশাসনকে দ্রæত পাঠাতে হবে।’ বুঝলাম সাংবাদিক হওয়ার এ
এক জ্বালা। নিশ্চয় জার্নালিস্ট পরিচয় দেখে ম্যানেজারের মাথা ঘুরে গেছে। ছুটে এসেছেন ছবি নিতে। বললাম, ‘ছবি তো নেই।’ বললেন, এক্ষুণি উঠিয়ে দিলে ভাল হয়। স্বামী বললো, আমার স্ত্রী অসুস্থ।
দুপুরের খাবার পর
কোথাও থেকে ছবি উঠিয়ে দেবো। ম্যানেজার
বললো, একটু তাড়াতাড়ি করবেন, না হলে গোয়েন্দা দফতর থেকে নানা ঝামেলা করবে’ । আসলে আমাদের কাছে কোন বাড়তি ছবি ছিল না। তাছাড়া শিলিগুড়িতেও লাগেনি। এখানে যে লাগবে কে জানে! বুঝলাম দেশের বাইরে কোথাও গেলে সঙ্গে ছবির অনেকগুলো কপি সবসময় রাখতে হবে।
বেশ কিছুক্ষণ পর হোটেলের ডাইনিং রুমে চলে এলাম। একটু অপেক্ষা করতেই ভাত, ডাল, সবজি
টক আর মাছের তরকারি চলে এলো। আমি মাছ খেলাম না। কোন রকমে ভাত-ডাল-সবজিটক
খেলাম। আমরা ব্যবহারের জন্য গরম জল
চাইতেই ঠান্ডা পানি বদলে দেয়া হয়েছিল।
খাবারের এ আয়োজনটা ভালই লাগলো।
কারণ যতো খুঁশি ভাত তরকারি খাওয়া যায়, চাইলেই দিয়ে যাচ্ছে। এজন্য কোন বাড়তি টাকা দিতে হবে না। খাওয়া শেষ হতেই স্বামী আমাকে একটা নাপা ট্যাবলেট খাইয়ে দিল।
তারপর ছুটলাম ছবি উঠতে। ডান দিক দিয়ে বামের দিকের রাস্তায় যেতে বলা হয়েছিল। সে রাস্তায় উঠতে হচ্ছিল খাঁড়া উপরের দিকে।
এভাবে খুঁজতে খুঁজতে জিজ্ঞেস করে করে ফটো তোলার স্টুডিও পেলাম। সেখানে ১০
মিনিটের মধ্যে দু’জনের ৫ কপি করে ১০
কপি ছবি দিলো।
তা এনে হোটেল ম্যানেজারের কাছে জমা দিলাম। গোয়েন্দা দফতরের পাঠানো ফরম পূরণ করে সই-সাক্ষর করতে হলো। ----------- চলবে -----------