শেকড়ের ডানা
ইয়াসমিন হোসেন
রাহুলের নতুন জীবন শুরু। প্রথমে ওকে কমরেড হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে হলো। আমরা কাকে মানুষ এবং কাকে মানুষরুপী অমানুষ হিসেবে দেখবো, কে মানুষের আসল শত্রæ, কাদের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করে মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে- এসব জানার জন্য যেমন ওকে বোঝানো হলো, তেমন ওকে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও সে তু-হো চি মিন-চে গুয়েভারার অনেকগুলো বই পড়ানো হলো। এভাবে টানা বেশ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ও পুরো একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলো। শুধু বই-পুস্তকের জ্ঞান নয়, অনুশীলন বা প্রাকটিক্যাল করার জন্য সরেজমিনে মাঠে প্রশিক্ষণ নিতে হলো। এভাবে এক সময় রাহুল নিজেকে অনেক অনেক শক্তিশালী মনে করলো। জানতেপারলো এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজের কথা, মানুষে মানুষে বিভেদ-বৈষম্যের কারণ। জানতে পারলো কার বিরুদ্ধে, কীভাবে লড়াই করে বিজয়ী হতে হবে।
বাড়িতে আহেদের বিরুদ্ধে বাদ-প্রতিবাদ এবং এক রকম যুদ্ধ করে রাহুল প্রশিক্ষণগুলো নিয়েছে। আর আহেদ সব বুঝতে পেরে থানায় গিয়ে ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে চলেছে। সে প্রতিদিন একবার করে থানায় যায়, আর অভিযোগ করে- Ôরাহুল ডাকাত হয়ে গেছে’ Ôওর কাছে অস্ত্র আছে’। ও তাকে Ôহত্যা করবে’। পুলিশ নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে সন্দিহান হয়ে উঠেছে। তাদের প্রশ্ন, একজন বাবা কী করে বাচ্চা ছেলের বিরদ্ধে এসব অভিযোগ করে? নিশ্চয় এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে। সেই কারণ খোঁজার জন্য অবশ্য পুলিশ আগ্রহী হয়নি। তবে আহেদের অভিযোগ নিয়েও মাথা ঘামায়নি। দেখছি, দেখবো- বলে প্রতিদিন তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর আহেদও প্রতিদিন ধর্ণা দিচ্ছে। কেন অভিযোগ দায়ের করার পরও পুলিশ রাহুলকে গ্রেফতার করছে না- এই প্রশ্নে আহেদ তার বন্ধুদেরকেও ব্যতিব্যস্ত করার চেষ্টা করছে।
আহেদের এমন ভূমিকায় রাহুলকে খুব সাবধানে চলতে হয়। রাতে বাড়িতে থাকে না। থাকে পার্টি সেল্টারে। দিনে চোখকান খোলা রেখে ফিরে আসে। সব সময় সতর্ক থাকে- পুলিশ বা রক্ষী বাহিনী ধরতে এলো কী না। কারণ পার্টির উপর চলছে স্টিমরোলার। প্রতি রাতে পুলিশ আর রক্ষীবাহিনী সন্দেহজনক বাড়ি এবং এলাকাগুলোতে কম্বিং অপারেশন চালাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই তরুণ-যুবকদের আটকের পর গুলি করে হত্যা করছে। তাই পার্টি এখন পুরো আন্ডারগ্রাউন্ডে। রাহুলকে খুব সাবধানে কমরেডদের সঙ্গে যোগাযাগ রক্ষা করতে হচ্ছে।
আহেদ একদিকে তার কঠিন অভাবে সময় কীভাবে পার করবে- তা নিয়ে ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিল না। আরেক দিকে রাহুলকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে কিছু পুরস্কার পাবে- এ আশায় থানায় ঘুরে তদবির করছিল। কিন্তু পলিশ পাত্তা না দেওয়ায় সুবিধা করতে পারছে না। সবকিছুর মধ্যদিয়ে আহেদের আসল লক্ষ্য কাজ করছিল- আরেকটি বিয়ে করা। বিয়ে করলে যৌতুক পাওয়ার একটা ধান্ধা আছে। কিন্তু রাহুলকে নিয়ে এখন ভয় তৈরি হয়েছে। কারণ কিছুদিন আগে রাহুলের পাঠানো দুইজন মোটাতাজা যুবক তাকে মাদ্রাসা থেকে ডেকে নিয়ে এমন সব ভয় দেখিয়েছে যে, হুট করে কিছু করতে আগের মত সাহস পাচ্ছে না সে। যা কিছু করছে সব গোপনে। কারণ যারা এই কম্বিং অপারেশনের মধ্যেও দিন-দুপুরে মাদ্রাসায় ঢুকে হুমকি দেওয়ার মত সাহস রাখে- তাদের হেলাফেলা করার নয়। সবমিলে মহাবিপদের মুখে পড়েছে আহেদ।
আসলে আহেদের হাতে এখন কোন টাকা-পয়সা নেই। দোকান-জমি বিক্রি করে যা জমা করেছিল, তার সবই খরচ হয়ে গেছে। তাই এখন একেবারে শূন্য হাত। সংসারটাকে ছোট করতে চেয়েছিল, স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের তাড়িয়ে দিয়ে নিজে একা হতে চেয়েছিল, কিন্তু এরজন্য কোন কৌশলই কাজে লাগেনি। তারপর বছর বছর নতুন মুখ জন্ম নিচ্ছেই। কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। আগে তবু মেছভাড়া, বাড়িভাড়া ছিল- এখন তাও নেই বললেই চলে। বেশি দিন কেউ থাকতে চায় না ঘর-বাড়ি ভাল নয় বলে। যেনতেন প্রকারে সবকিছু সামলাতে গিয়ে ফল হয়েছে বুমেরাং। এরইমধ্যে রাহুলের সঙ্গে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কী হবে বুঝতে পারছে না সে।
----- চলবে ------