শেকড়ের ডানা
ইয়াসমিন হোসেন
এক.
রায়টের সময় শহরটাতে এসেছিল আহেদ আলী। তখন ‘হিন্দু খেদাও’ অভিযান চলছিল। ওপারে চলছিল ‘বিহারী খেদাও’ অভিযান। সুযোগটাকে যে যার মত কাজে লাগিয়েছিল। আহেদ আলীও বাদ যায়নি। শহরের ভেতর একটা বিরাট জায়গা পছন্দ হয়েছিল। জঙ্গল আর গাছপালায় ভরা জায়গাটা ছিল এক হিন্দু মহিলার। রায়টের ভয়ে গাঢাকা দিয়ে দিন কাটাচ্ছিল। আহেদ আলী তাকে চাপে ফেলে জায়গাটা তার কাছে বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে যেতে বলেছিল। না হলে জীবনটা আর নাও থাকতে পারে বলে খুব কৌশলে ভয় দেখিয়েছিল। মহিলা প্রাণের ভয়ে তাই করেছিল। নামমাত্র পয়সায় দলিল করে দিয়ে ইন্ডিয়া ভেগেছিল। সেই থেকে বিরাট জায়গাটার মালিক হয়েছিল আহেদ আলী।
গোটা এলাকা জুড়েই ছিল হিন্দু বসতি। মুসলমান বলতে এক আহেদ আলীই। শক্তি-সামর্থের কথা বিবেচনা করে এটাকে সুবিধের মনে হয়নি তার। তখন সে তার গ্রামের বন্ধু রহমানকে প্রভাবিত করেছিল। জানিয়েছিল মধ্যস্থতা করে সে খুব কম পয়সায় চমৎকার জায়গা কিনে দিতে পারবে। আহেদ আলী সেটাই করেছিল। সে তার পাশের জায়গাটা শুধু রহমানকে কিনেই দেয়নি, মধ্যস্থতার সুবাদে দু’পয়সা হাতিয়েও নিয়েছিল।
শহরটাতে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। কেরসিনে জ্বালানো ল্যাম্পপোস্ট ছিল। পৌরসভার লোকেরা সন্ধ্যে বেলায় কেরসিন ঢুকিয়ে সলতেয় আগুন দিয়ে যেতো। সারারাত মিটমিট করে জ্বলতো সেগুলো। পাকা রাস্তাঘাটও তেমন একটা ছিল না। আহেদ আলী যেখানে জায়গা কিনেছিল তার দুধারে ছিল মাটির কাঁচা রাস্তা।
দক্ষিণ কোণার দিকে একটা থাকার ঘর ছিল। ছনের ঘর, ছনের বেড়া। আহেদও সেটাই থাকার ঘর বানালো। ছোট্ট ঘরটার সামনে রান্না-বান্নার ব্যবস্থা ছিল। জায়গাটার ভেতর ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত আরও একটা ঘর ছিল মাঝামাঝির দিকে। সেটায় কিছু করার ছিল না। বাকি সব জায়গা ছিল জঙ্গলে ভরা। তার ভেতর আম, কলা, নারিকেল, পেপে, পেয়ারা গাছসহ ফলমূলের নানান গাছ-গাছালি ছিল। আহেদ আলী সীমানার দিকে ঝোপঝাড় আর দেবদারু গাছের সারি রেখে একটু পরিস্কার করে নিয়েছিল।
এরইমধ্যে প্রায় হাত খালি হয়ে গিয়েছিল আহেদের। তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। তাই কিছুদিন রাস্তায় রাস্তায় শাড়ি-লুঙ্গি ফেরি করে দু’পয়সা কামানোর চিন্তা করেছিল। কিন্তু খুব একটা সুবিধের হয়নি। এই সময়ই সিএন্ডবি অফিসে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি পদে একটা চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু বেতন না পাওয়া পর্যন্ত হাতের অবস্থা শূন্যই ছিল। ভাগ্য ভাল, তখনই রহমানকে পূবের জায়গাটা কিনে দিয়ে দুটো পয়সা এসেছিল। কিন্তু এরপর? এরপর কিভাবে চলবে? আহেদ ভাবছিল এখন কী করা যায়।
ছোট্ট সংসার। স্ত্রী আর সদ্য ভূমিষ্ট এক ছেলে সন্তান। তাদের জন্য অবশ্য টাকা-পয়সা খরচ করে না সে। যেমন, সন্তান ভূমিষ্টের জন্য স্ত্রীকে হাসপাতালে নেয়নি। ভিক্ষে করা দাইমাকে একপেট খাইয়ে কাজ সেরে নিয়েছিল। কোন বাড়তি খরচ তার একদম পছন্দ নয়। আবার স্ত্রীজাত নিয়েও অন্যরকম ভাবনা। এদের পিছনে খরচ করা যৌক্তিক মনে হয় না। দেহের ক্ষুধা মেটানোটাই এখানে আসল। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের আসা-যাওয়াও তার অপছন্দ। কারণ তাতে একটা খরচের ব্যাপার থাকে। যদিও নিজের লাভের ব্যাপারটা সে খুব ভাল বোঝে। যেখানে লাভ সেখানে তার আপত্তির কিছু থাকে না।
আহেদ আলী একটা পরিকল্পনা করে ফেললো। দুই-চার বছর যাই-ই লাগুক না কেন এটা বাস্তবায়ন করতে চায় সে। তার টাকা চাই, আরও সম্পদ চাই। সম্পদটা হয়তো এই মুহূর্তে পাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু টাকা পাওয়া সম্ভব। এজন্য তার প্রথম টার্গেট হলো বন্ধু রহমান। সে বেশ বিত্তবান মানুষ। তাকে কায়দা করে বোঝাতে পারলেই হলো। আহেদ তাকে যে জায়গাটা কিনে দিয়েছে, সেটা পরিত্যক্ত। জায়গা জুড়ে রয়েছে জঙ্গল আর নারকেল বাগান। এই বাগান পরিস্কার করলেই এটি বসবাস করার জায়গা হয়। রহমানকে এটাই বোঝাতে হবে। তারপর রহমান সব দায়িত্ব আহেদ আলীর উপর ছেড়ে দেবে। আর তখন আহেদ প্রথমেই নারকেল গাছগুলো কেটে বিক্রি করবে। কতোগুলো গাছ ছিল, কী পরিমাণ নারকেল ছিল, কতো টাকায় বিক্রি হয়েছে, কামলার মজুরি বাবদ কতো খরচ হয়েছে- এসব কিছুই দেখার মানুষ নয় রহমান। সুতরাং এই কাজ করে বড় অংকের লাভ পকেটে তুলতে পারবে আহেদ। লাভ দিয়ে নিজের জায়গায় অনেক কিছুই করতে পারবে। বিলম্ব না করে লক্ষ্য বাস্তবায়নে নেমে পড়লো সে।
---- চলবে -----