রবিবার, ২ মে, ২০২১

তাজমহলে একদিন

 


তাজমহল
চত্তরের একটি দৃশ্য


তাজমহলের
উপর কয়েক টুরিস্টের সঙ্গে আমরা


তাজমহলের
অন্দরে লেখক


তাজমহলের
ভেতরে দিকে টুরিস্ট দলের যাত্রা


আরও
কাছে তাজমহল


তাজমহলের
সামনে আমরা


তাজমহল
দর্শন


তাজমহলের
আরেকটি দৃশ্য


তাজমহলের
সামনে লেখক


ফটক
পেরুতেই তাজমহল


তাজমহলে একদিন

-       ইয়াসমিন হোসেন

আগ্রার তাজমহল সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি। এটা মোঘল সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি, ভালবাসার ঐতিহাসিক নিদর্শন। নির্মাণ হয়েছিল ৩৬৫ বছর আগে ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে। পৃথিবীর সবচেয়ে নামী-দামি পাথর, অলঙ্কার এবং কারুকাজ দিয়ে তৈরি সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগমের প্রতি ভালবাসার এই অনন্য সুন্দর নিদর্শনে সবকিছুই চোখ ধাধানো। কিন্তু যতোই চোখ ধাধানো হোকÑ গরমকালের ধাধানো আগুন সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিচ্ছিলো। সূর্য্যরে তপ্ত আগুনকে আরও আগুন করে বিকিরণ ঘটাচ্ছিল পাথর, অলঙ্কার, কারুকাজ। সুতরাং আবারও বলছি, ভুলেও কেউ গরমকালে ভালবাসার তাজমহল দেখতে যাবেন না। যাবেন শীতকালে।

হ্যাঁ, যে তাজমহলÑ এটির নির্মাণে সময় লেগেছিল ২২ বছর অর্থাৎ ১৬৩০ থেকে ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। নির্মাণ কাজে ছিল পৃথিবীর সর্বোত্তম আর্কিটেক্ট এবং শ্রমিক দল। ২২ বছর ধরে ২০ হাজার শ্রমিক কঠোর পরিশ্রম করে জন্ম দিয়েছিল তাজমহলের। যদিও গোপন রয়েছে এই আর্কিটেক্ট এবং নির্মাতাদের নাম-পরিচয়। ফলে আজও কেউ জানেন নাÑ কারা শ্রম-ঘামে নির্মাণ করেছিল এই মহল। তাজমহলে রয়েছে সম্রাজ্ঞী মমতাজ এবং সম্রাট শাহজাহানের সমাধি।

সন্তান প্রসবের সময় সম্রাজ্ঞী মমতাজ মারা যান। এর দুবছর পর শাহজাহান ভালবাসার এই নিদর্শন গড়ার উদ্যোগ নেন। নিয়তির নির্মম পরিণতিÑ এই নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর নিজের পুত্রই তাকে বন্দি করে ক্ষমতা দখল করেন। এরপর শাহজাহানকে রাখা হয় আগ্রা ফোর্টের সোনার মহলে। মৃত্যু পর্যন্ত সে মহলেই বন্দি ছিলেন তিনি। সেখানে জানালায় বসে দূর থেকে তিনি শুধু দেখতে পেয়েছেন তাজমহল, কল্পনায় দেখতে পেয়েছেন তার ভালবাসার মমতাজকে।

মৃত্যুর পর সম্রাট শাহজাহানকে চির শায়িত করা হয় মমতাজের কবরের পাশে। দুটি কবরই রয়েছে তাজমহলের যে গম্বুজÑ ঠিক তার নিচে। সব মিলে ইতিহাসের নানা কাহিনী আর নিদর্শনের মহাভান্ডার নিয়ে যমুনার তীরে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীখ্যাত আগ্রার তাজমহল।

আগের ভুলটার খেশারত আমাদেরকে আবারও দিতে হলো। ট্যুরিস্ট বাস তাজমহল ফটক এলাকায় থামতেই এগিয়ে এলেন গাইড। বললেন, এখানে ইন্ডিয়ানদের জন্য টিকেটের মূল্য ২০টাকা, কিন্তু ফরেনারদের জন্য ৭শ টাকা। আপনাদের দুজনের ১৪শ টাকা দিতে হবে। 

আমরা (আমি এবং আমার স্বামী) জোর আপত্তি জানালাম। বললাম, তাজমহল দেখবোই না, এতো টাকা খরচ করবো না, বাইরে থেকে যেটুকু দেখতে পারছি তাই- দেখবো। তখন তিনি চিন্তিতভাবে বললেন, ঠিক আছে আপনাদের জন্য একটা ব্যবস্থা করছি।

তিনি ততোক্ষণে ইন্ডিয়ান যাত্রীদের কাছ থেকে ২০ টাকা করে নেওয়ার পর আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘আপনারা ৭শ টাকা দিন। বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেবো। ঢুকতে কোন অসুবিধা হবে না।

বাধ্য হয়ে ৭শ টাকা দিতে হলো। উনি ঘুরে এসে আমাদের হাতে ২০ টাকার দুটি টিকেট ধরিয়ে দিয়ে পাসপোর্টটা আগের মতোই নিয়ে নিলেন। বুঝলাম, গাইড সাহেবের পকেটে ঢুকলো বাকি ৬শ ৬০টাকা।

টিকেট দেখিয়ে আমরা দিব্বি ঢুকে পড়লাম ভেতরে। এরপর বেশ খানিকটা হেঁটে আরেকটি প্রবেশ পথে দাঁড়াতে হলো। সেখানে পায়ে বাঁধার জন্য সাদা ধপধপে নরম একরকম কাপড় দেওয়া হলো। এটা জুতাসহ পায়ে পড়তে হলো। এর কারণ, মহামূল্যবান পাথর এবং কারুকাজ যেন পায়ের চাপে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। সব ট্যুরিস্টকেই এটা পড়া বাধ্যতামূলক। সিসি ক্যামেরায় এটার উপর নজরদারি করা হয়। সুতরাং ভেতরে গিয়ে কাপড় খুলে ফেলার উপায় নেই। অবশ্য খুলে ফেলার ইচ্ছেও হয়নি দুই কারণে। একটা কারণ হলোÑ কাপড়ের এই আবরণটি বেশ আরামদায়ক, দ্বিতীয়টি হলোÑ মার্বেল পাথরের তপ্ত রাস্তা থেকে এটা পা কে কিছুটা হলেও রক্ষা করছিল।

লাল টকটকে বিশাল পথ দিয়ে ঢুকতেই চোখের সামনে ধপ করে উদয় হলো উজ্জ্বল ধপধপে সাদা চিরচেনা তাজমহল। প্রচন্ড গরম সত্তে¡ তার সামনে দর্শণার্থীর ভিড়। আমরা কিছু সময় লাল প্রবেশ ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করার চেষ্টা করলাম।

আমাদের অবস্থান থেকে বেশ কিছুটা হেঁটে যেতে হবে তাজমহল চত্তরে। গেট ভবন থেকে নেমে সামনের দিকে এগিয়ে ডানে বাঁক নিয়ে অনেকের সঙ্গে এগুতে থাকলাম। পাশে পানির ফোয়ারা এবং রিজার্ভ ট্যাঙ্কির মতো জায়গা পেরিয়ে লাল কার্পেটের উপর দিয়ে ঢুকতে হলো মূল চত্তরে। ততোক্ষণে আমার তো গরমে জ্ঞান হারাবার দশা হলোই, অনেক ছোট বাচ্চাকে চত্তরের ছায়ায় বসে পড়তে দেখলাম। কিছুক্ষণ দম নিয়ে ফের যাত্রা।

সাদা পাথরের লম্বা দেওয়াল, কিছুতেই শেষ হতে চায় না। ডানে যমুনা নদী। পানি কম। দূর থেকে অনেকটাই নালার মতো মনে হচ্ছিল। আমরা পাথরের দেওয়াল শেষ করে তাজমহলের ভেতরের দিকটায় ঢুকে পড়লাম। বাইরে থেকে মনে হয়েছিল তাজমহল বুঝি একটা ভবন। আসলে তা নয়। মাঝখানটা ফাঁকা, চারপাশের কারুকার্যময় দেওয়াল দিয়ে বানানো ভবনের মতো আদল করা হয়েছে। মাথার উপর খোলা আকাশ। গরমে ভেতরটায়ও দাঁড়ানো যাচ্ছিলো না। কোন রকমে কিছু জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলে দ্রæ বেরিয়ে আসার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। আমাদের ট্যুরিস্ট বাসের সঙ্গীরাও ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিছু সময় কাটাতে গিয়ে তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাওয়া শুরু করলো। তখন নিরাপত্তা কর্মীদের একজন আমাদের কাছ থেকে পানির বোতল নিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেল। ফিরে এলো বরফ ঠান্ডা পানীয় জল নিয়ে। খুব সাবধানে পান করতে হলো। কারণ আগ্রা ফোর্টের কথা ভুলিনি।

এতো আশায় এতো স্বপ্নে বুক ভরে এসেছিলাম এই তাজমহল দেখতে, কিন্তু সর্বনাশা গরম সব মাটি করে দিলো। অবস্থাটা এমন হলো যে, এখান থেকে যতো দ্রæ সম্ভব পালিয়ে ট্যুরিস্ট বাসে উঠে এসির দেখা পাওয়াটাই যেন জরুরি। কিন্তু চাইলেই তো আর হয় না। আমরা দলবদ্ধভাবে এসেছি, ফিরতেও হবে দলবদ্ধভাবে। আর সবাই তো একই সময়ে বেড়ানো বা দেখার কাজ শেষ করতে পারছিলেন না। তাছাড়া তাজমহল থেকে বাসের জায়গায় যাওয়াটাও কম দূরের নয়। আসার সময় বাস থেকে নেমে কেউ রিকশা, কেউ ঠেলা, কেউ ঘোড়ার গাড়ি, কেউ সিএনজি বা ট্যাক্সি ভাড়া করে তাজমহল গেটে এসেছিলেন। যেতেও হবে সেভাবে।

আমরা কয়েকজন মিলে দুটো সিএনজি ভাড়া করে বাসের কাছে চলে এলাম। তারপর তাতে উঠে এসির নিচে ঠান্ডা হওয়ার চেষ্টা করলাম। তখনই গাইড এসে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে বকশিস দাবি করলো। আমরা বিরক্ত হয়ে চোখ গরম করতেই তিনি বললেন, না, থাক দিতে হবে না।

দিল্লী-আগ্রা ভ্রমণের এখানেই যে সমাপ্তি তা কিন্তু নয়। ফেরার পথে ছিল রাধাকৃষ্ণ জন্মস্থান মাথুরা ঘোরার পালা। কিন্তু সেই ঘুরতে গিয়ে যে নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে এবং বেরিয়ে আসবে অনেক গোমড়Ñ তা ভাবিনি।

শুরু হলো যাত্রা। তাজমহল দেখতেই বিকেল পেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যের আগ দিয়ে বাস রওনা হলো। আগ্রা থেকে দিল্লী যেতে ঘণ্টা মতো লাগার কথা। কিন্তু মাঝ পথ পাওয়ার আগেই মাথুরা ঘুরতে হবেÑ সেহেতু দিল্লী পৌঁছাতে রাত কটা হবে, তা নিয়ে শঙ্কা শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে হোটেলের কাউন্টারে দেখে এসেছি, রাত ১১টার পর কাউকে ভেতরে  ঢুকতে দেওয়া হয় না। এখন যদি ফিরতে ফিরতে রাত ১১টা পেরিয়ে যায়Ñ তাহলে কী হবে! অচেনা জায়গা। নানান চিন্তা। যাই হোক, বাস চলতে লাগলো একেবারেই ঢিমে তালে। যেন মুড়িরটিন মার্কা গাড়ি। ঢাকায় হলে না হয় কথা ছিল, কিন্তু ভারতের রাজধানীতে এসে এমন দেখবো ভাবিনি। সন্ধ্যের বেশ পর এক জায়গায় এসে বাস পুরো থামিয়ে দেওয়া হলো। বলা হলো, পাশে একটা স্বর্ণ মন্দির আছে, দেখার মতো। সেটায় যেতে হবে। তবে ক্যামেরা নেওয়া যাবেনা, ছবি তোলা নিষিদ্ধ। কথা শুনে আমার স্বামী বললো, ছবি তুলতে না পারলে সে যাবে না। সে সত্যিই থেকে গেল। আমরা দল বেঁধে রওনা হলাম। দেখলাম স্বর্ণ দিয়ে তৈরি বিশাল দেবতার প্রতিকৃতি। অনেকেই দেবতাকে শ্রদ্ধা জানালেন, সাধ্যমত টাকা-পয়সা তুলে দিলেন।

এই স্বর্ণ মন্দির থেকে ফিরতে চলে গেল প্রায় দেড় ঘণ্টা মতো। এরপর বাস আবার রওনা হলো। একটা কথা বলা হয়নি। আগ্রা ছাড়ার সময়ই গাইড বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। তার বদলে যুক্ত হয়েছেন আরেক গাইড নামের এমন এক ব্যক্তি, যিনি অনবরত বাসের ভেতর বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন। এই বক্তৃতা বক্তৃতার মতো হলে কথা ছিল। তিনি হিন্দু ধর্মের নানা বিষয় এমনভাবে বর্ণনা করছিলেনÑ সেটা মোহিত করার মতো হলেও সা¤প্রদায়িক দিক থেকে বেশ আপত্তিকর। তাও ভাল ছিল, কিন্তু যতো সময় যাচ্ছিলÑ তার বক্তৃতার ধরণও বদলে যাচ্ছিল। এক সময় তিনি মাথুরার ইতিহাস বর্ণনা করতে করতে বৃন্দাবন এবং রাধাকৃষ্ণের বিষয়ে এমনসব কথা বলতে লাগলেন, যাতে আর মনে হলো না তিনি গাইড। মনে হলো, তিনি যেন কোন হিন্দু মৌলবাদী দলের উগ্র নেতা। বলতে লাগলেন সা¤প্রদায়িক উস্কানিমূলক নানা কথা। এক পর্যায়ে তিনি তাজমহল সম্পর্কে নানা আপত্তিকর কথা বলেÑ কেন আমরা এটা দেখতে যাই, মোটেও যাওয়া উচিত নাউল্লেখ করে ফেললেন। আহ্বান জানালেনÑ তিনি যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে বারবার দর্শন দেওয়ার জন্য। তিনি এও বললেন, এই এলাকা হিন্দু দেবদেবীদের। এখানে অন্য কোন ধর্মের স্থান নেই। তিনি রাস্তার পাশের কয়েকটি মন্দির দেখিয়ে বললেন, এসব জায়গায় মসজিদ ছিলো, সেগুলো গুড়িয়ে দিয়ে এসব মন্দির করা হয়েছে। তিনি আহŸান জানালেনÑ সবাইকে হিন্দুত্ববাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য।

যাত্রীদের অনেকেই তার ধরণের বক্তৃতায় বিরক্ত হচ্ছিলেন। কিন্তু কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে মনে হলো, পুরো ট্যুরিস্ট বাসটাকেই যেন এই গাইড জিম্মি করে ফেলেছেন। কেউ একটা কথা বললে, তার মহাবিপদ হবেÑ এমন একটা ধারণাও তৈরি করে ফেললেন।

এভাবে রাত ১০টার দিকে গাইডের ভাষ্যমতো- মাধুরার বৃন্দাবনে আসা হয়েছে বলে জানানো হলো। বাসের সবাইকে সেখানে নামতে বাধ্য করা হলো। তারপর এই গাইডের একদল অনুসারী এসে যোগ হলো এবং সবাইকে বেশ দূরের এক জায়গায় একটি ভবন দেখিয়ে সেখানে ঢোকানো হলো। আমরা ততোক্ষণে দারুণ শঙ্কিত হয়ে পড়েছি। কিন্তু কিছু বলার মতো সাহস পাচ্ছি না। সবাই ওই গাউডের নির্দেশ মানতে বাধ্য হচ্ছি। গাইড আমাদের একটি মন্দিরের সামনে বসিয়ে আরও কয়েকজনকে দিয়ে বক্তৃতা পর্ব পরিচালনা করলো। তারপর বললো, এই মন্দিরের দেবতাকে খুঁশি করতে সবাইকে নগদ টাকা এবং শরীরের গহনা খুলে দিতে হবে। আশ্বাস দেওয়া হলো, কে কি দিচ্ছেনÑ তা লিপিবদ্ধ রাখা হবে। কয়েকটি রশিদ বই দিয়ে বলা হলো, এতে নাম ঠিকানা লিখে কে কি দান করছি তার বিবরণ লিখতে হবে।

এবার আমার স্বামীসহ বেশ কয়েকজন মরিয়া হয়ে বিদ্রোহ প্রকাশ করলো। বললো, আমরা লিখবো না, কিছু দিতেও চাই না, কারণ আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী নই। তাছাড়া আমরা ধর্ম পালন করতে আসিনি। 

তাতে দারুণ ক্ষুব্ধ হলেন গাইডসহ তার অনুসারীরা। কিন্তু আমরা অনড় রইলাম। তখন আমাদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য নানা বাক্য ছুঁড়ে ছুঁড়ে বাকি সবার কাছ থেকে তারা নগদ টাকা, গহনা ইত্যাদি আদায় করতে সক্ষম হলেন। এভাবে দীর্ঘ ঘণ্টা দেড়েক আটকে রেখে আমাদের আবার বাসের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো।

বাস চলতে শুরু করলো ঢিমে তালে। আর গাইড এবং তার সঙ্গীরা আমাদের কয়েকজনের দিকে রক্তচক্ষু দেখিয়ে এক জায়গায় নেমে পড়লেন। আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এরপর আস্তে আস্তে মুখ খোলা শুরু করলেন যাত্রীদের অনেকেই। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেটা মোটেও বৃন্দাবন বা রাধাকৃষ্ণের মন্দির নয়। আসলে পরিকল্পিতভাবে আমাদের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য কান্ড করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যেও ফিস ফিস করে কথা বললাম। নিঃসন্দেহে এই গৌতম ট্যুরিস্ট সার্ভিস হিন্দু মৌলবাদী জঙ্গি চেতনার কোন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। না হলে এই কান্ড হবার কথা নয়। তবে আমরা আরও বড় কোন বিপদে পড়িনিÑ সেটাই রক্ষা!

রাত যখন ১টা বেজে গেছে তখন এই বাস এসে থামলো সেই সকাল বেলার নাস্তা করার মতো আরেকটি মেঠো হোটেলে। কিন্তু আগেই যা শিক্ষা হবার হয়ে গেছে। আর নয়। সব যাত্রী একযোগে প্রতিবাদ করে জানালেন, আমরা হোটেলে খাবো না। দিল্লী চলুন। কিন্তু বাসের চালক নাছোর বান্দা। তিনি বাসের স্টার্ট এবং এসির সুইচ বন্ধ করে নেমে পড়লেন। হোটেলে খাই না খাই এখানে নাকি তাকে এক ঘণ্টার বিরতি দিতেই হবে। এটা কোম্পানির নির্দেশ। কথা বলে চালক যে কোথায় চলে গেলেন, এক ঘণ্টার আগে আর এলেন না।

বাসের ভেতর আমরা সবাই এসি ছাড়াই গরমের ভেতর বসে কাটালাম। অবশ্য কেউ কেউ নেমে প্রাকৃতিক কাজ সারলেন। খাবার জন্য কেউ গেলেন না। হোটেলের লোকজন এসে খুব অনুনয়-বিনয় করতে লাগলো। শেষে বললো, দেখুন আপনারা আসছেন বলেই খাবার তৈরি করা হয়েছে। না খেলে সব নষ্ট হবে।

আমরা অনড় থাকলাম। কেউ সাড়া দিলাম না।

ঘটনা থেকে অনেকটাই পরিস্কার হয়ে গেলÑ টুরিস্ট কোম্পানিটি সিন্ডিকেট করে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে। হোটেল, গাইড এবং বৃন্দাবনের চক্রÑ ইত্যাদি সবই নেটওয়ার্কের বা সিন্ডিকেটের অংশ। আমরা যে হোটেলে উঠেছি সেটাও তাই- কিনা কে বলবে! বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশেও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী রয়েছে। এদের কেউ ধর্মকে হাতিয়ার করে মানুষজনকে বিভ্রান্ত করে, পারলৌকিক নানা প্রাপ্তির কথা বলে কিংবা ভয়ভীতি ছড়িয়ে টাকাপয়সা হাতানোর কারবার করে। কেউ ধর্মকে পুঁজি করে জঙ্গি রাজনীতি করে, আবার কেউ প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও সিন্ডিকেট করে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। আমাদের দেশে মুসলিম ধর্মের নামে এই কান্ড করা হয়, আর ভারতে করা হচ্ছে হিন্দু ধর্মের নামে। চরিত্র লক্ষ্য একই।

খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলামÑ কটায় দিল্লী পৌঁছাবো, কোথায় নামিয়ে দেওয়া হবে, কীভাবে হোটেলে পৌঁছাবো এবং হোটেলে ঢুকতে পারবো কিনা? না ঢুকতে পারলে কীভাবে রাত কাটাবো? ভাগ্যিস আসার সময় হোটেলের একটা কার্ড নিয়ে এসেছিলাম। বাসে বসে সেটা থেকে ফোন নম্বর বের করলাম। তারপর মোবাইল থেকে ফোন করে জানালাম আমাদের বিলম্বের কথা। জবাবে হোটেল থেকে বলা হলোÑ কোন সমস্যা নেই, যতো রাতই হোক আমাদের জন্য গেট খোলা হবে।

হোটেলে প্রবেশ করার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। থাকলোÑ কখন পৌছাঁবো, কোথায় আমাদের ড্রপ করা হবে? কারণ সম্পর্কে বাসের কন্ডাক্টর পরিস্কার কিছু বলতে পারছিল না।

রাত সোয়া তিনটার দিকে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হলো, সকালে আমরা যেখান থেকে উঠেছিলামÑ তার উল্টো জায়গায়। সকালে তবু ওদের ছেলে আমাদের জায়গামতো নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এই গভীররাতে যেখানে নামিয়ে দেওয়া হলো সেখান থেকে কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না। রাস্তায় একটা লোক নেই, কোন পাহারা বা পুলিশও চোখে পড়ছিল না। এখানকার আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কেও কোন ধারনা নেই। ছিনতাইকারী, অপহরণকারীদের কবলে পড়বো কিনাÑ ভাবছিলাম। আমাদের সঙ্গে রয়েছে টাকা-পয়সা-ডলার। রয়েছে মোবাইল-ক্যামেরা-পাসপোর্ট। সব হারাতে হবে কিনাÑ তাই নিয়ে চিন্তায় প্রচন্ড গরমেও  শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।

বাসটা আমাদের দায়িত্বহীনভাবে নামিয়ে দিয়ে যাবার পর অনুমানের উপর ভর করে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর এসে একটা হোটেলের সামনে লোকজন এবং পাহারাদার দেখলাম। তাদের কাছ থেকে জানলাম দিল্লী রেল স্টেশনের নম্বর গেট কোন দিকে। কারণ সেই গেটের সামনেই আমাদের পাহাড়গঞ্জেরহোটেল হরিকিশান গেস্ট হাউজ আমরা সেইমতো আতঙ্কের ভেতর প্রায় ২০ মিনিট হেঁটে হোটেলের সামনে পৌঁছলাম। ডাকাডাকি করতেই হোটেল বয় রতন এসে গেট খুলে দিলো। আমরা রুমে ঢুকে পড়লাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for Message

ঢাকা থেকে মালদ্বীপ ভ্রমণ- ৩ [Dhaka to Maldives Travel-3]

  ঢাকা থেকে মালদ্বীপ ভ্রমণ - ৩ [Dhaka to Maldives Travel-3] ঢাকা থেকে মালদ্বীপ ভ্রমণ- ৩ [Dhaka to Maldives Travel-3] : কোথাও নীল কোথাও স...