রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

গল্প : ধারাবাহিক [পর্ব- ছয়] শেকড়ের ডানা

 

শেকড়ের ডানা

ইয়াসমিন হোসেন

আহেদের গবেষণাগারের বদৌলতে রাহুল হঠাৎ এক ভয়ঙ্কর তথ্য পেয়ে গেলো এই তথ্য থেকে ওর কাছে পরিস্কার হয়ে গেল, কেন -সহ মা-ভাই-বোনদের উপর পৈশাচিক নির্যাতনের স্টিমরোলার নেমে এসেছে কেন ওদের না খাইয়ে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে, কেন পুরনো ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে, আর কেনই বা মাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত এবং অজ্ঞান করে ফেলা হচ্ছে বার বার কেন বলা হচ্ছে, সবাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে

রাহুল সেদিন গবেষণাগারের কথা শোনার জন্য আঁড়ি পেতেছিল আহেদ ওই মওলানাকে বলছিল, সে নাকি সফল হওয়ার দিকে তার পাশের বাড়ির বন্ধু হাশেম মাস্টারকে পটিয়ে ফেলেছে এবং সে কয়েক দিনের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাচ্ছে আহেদও সেইভাবে এগুচ্ছে পরিবারের লোকজনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলেই মওলানাকে নিয়ে গ্রামের দিকে যে চাষীর মেয়েকে দেখে এসেছে- তাকে বিয়ে করবে ওই মেয়ের নামে ওখানকার যেটুকু জমি ছিল, সেটুকু লিখে দেওয়ার সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে হাশেম মাস্টারের বাড়ির কাজের মেয়েটাকে যদি বিয়ে করা যেতো তাহলে জমি দিয়ে চাষীর মেয়েকে আনতে হতো না কিন্তু কাজের মেয়ে রাজী হলো না আহেদ যোগ করলো, ‘পরিবারের উপর যে শাস্তি দিয়ে চলেছি, তা আর কতো সহ্য করবে? এখন ওদের বিদায় হতেই হবে বিদায় হলেই আসবে আহেদের নতুন জীবন

ঘটনা জেনে ক্রোধে গা রি রি করতে লাগলো রাহুলের কী করবে এখন ? এই বয়েস কোন কিছুই করার নয় ওর কথায় কেও সাহায্যে এগিয়ে আসবে না অনেক ভাবলো রাহুল কারও কোন সাহায্য পাবে না কাউকে জানিয়েও কিছু হবে না যা করার ওকে নিজের মত করেই করতে হবে বিশেষ করে এই গবেষণাগার আগে ভেঙে দিতে হবে মওলানাকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে কিন্তু কীভাবে? কোন উপায় পেলো না রাহুল

পরিকল্পনা নিয়ে যখন অনেক করে ভাবছিল তখন আহেদ ওকে ডেকে নিয়ে জানালো, ‘আগামীকাল তোর ফুপুর বাড়ি যাবো, তোকেও সঙ্গে যেতে হবে মুখের উপর না বলার উপায় ছিল না বাধ্য হয়ে পরের দিন ওকে আহেদের সঙ্গে যেতে হলো প্রায় আধাদিনের বেশি পথ যেতে যেতে আহেদ ওকে নানান উপদেশ দিলো প্রথমে ধর্মের নানা বাণি আর কাহিনী শোনালো রাহুল কিছু বিশ্বাস করলো আর কিছু করলো না কারণ বাবার উপর ওর বিশ্বাস হারিয়ে গিয়েছিল শেষে জানালো, এখন থেকে ওকে গ্রামেই থাকতে হবে ফুপুর বাড়িতে কোন অসুবিধা হবে না বললো, এখানে থেকে দরকার হলে স্কুলে ভর্তি হবি আর ধান কাটা, কাপড় তৈরির কাজ শিখবি

রাহুল তার বাবার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলো আসলে ওকে গ্রামে আটকে রাখতেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একজন বন্দির মতো ওকে যেতে হচ্ছে কিছু করার নেই ভিতরে ভিতের রাগে-ক্ষোভে ফুঁসতে লাগলো

গ্রামে ফুপুর বাড়িতে রাহুলকে রেখে চলে গেল আহেদ ওর অন্যরকম বন্দিজীবন শুরু হলো ফুপু-ফুপা বা তার ছেলে-মেয়েরা কেও নামাজ না পড়লেও ধর্মান্ধ কথায় কথায় ধর্মের বুলি আওরায় নিজের স্বার্থে ধর্মের ব্যাখ্যা দেয় তাদের সঙ্গে রাহুলকে কাপড় তৈরি, ধান কাটা, মাড়াই, হাট-বাজারে যাওয়ার কাজ করা শুরু হলো

মাসখানেক পর বিদ্রোহ করে বসলো রাহুল কারও কথা শুনবে না কোন কাজ করবে না খাবেও না ওকে বাড়িতে যেতে দিতে হবে এই দাবিতে পুরো অসহযোগ শুরু করলো কোন ভয়-ভীতি-নির্যাতনেও টললো না কারণ বাড়িতে বাবা কী ভয়ঙ্কর তৎপরতা চালাচ্ছে তা নিয়ে অস্থির

ওর বিদ্রোহে কাজ হলো কয়েক দিনের মধ্যে ওকে বাড়িতে পৌছে দেওয়া হলো জানতে পারলো বাবার বন্ধু মাস্টার সাহেব দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলেছেন শুধুই তাই- নয়, রাহুল ওর বয়স থেকে একটু বড় মাস্টার সাহেবের ছেলের কাছ থেকে জানতে পারলো- সংসারে চরম অশান্তির পর ওর বাবা নতুন মাকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেছে রাহুল আরও জানতে পারলো, আহেদের পরামর্শে সব করা হচ্ছে এটাকে তালাক দিয়ে নতুন আরেকটা বিয়ের জন্য মাস্টারকে রাজী করানো হয়েছে আর আহেদ নিজে দ্বিতীয় বিয়ে সম্পন্ন করেছে এবং আজ-কালের মধ্যে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসবে বাড়ির মওলানা সাহেবের ঘরের আলাপ থেকে এটা জানতে পারলো

রাহুলের মাথা খারাপ অবস্থা বিষয়টা মাকে জানালো মা ধর্মের অজুহাত দেখিয়ে আহেদের পক্ষ নিলো তার কথা, আহেদ যা করছে তা ধর্মমতেই করছে হাসিদ-কোরআনে এটাই বলা আছে এমন তথ্য শুনে অসহায় বোধ করলো রাহুল

পরদিনই আহেদ তার নতুন বিয়ে করা স্ত্রীকে নিয়ে এলো রাহুল তখন পর্যন্ত একই ঘরে থাকতো এবার ওকে সামনের আলাদা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো অন্য ভাই-বোনদের একই ঘরে পৃথকভাবে থাকার ব্যবস্থা হলো ক্রধে উন্মত্ত রাহুল কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না তবে মনে মনে ঠিক করে ফেললো, যে করেই হোক বাবার গবেষণাগারকে ভেঙে দিতে হবে মওলানাকে আগে তাড়াতে হবে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলো

এরমধ্যে একমাস কেটে গেল আহেদ তার বন্ধু মাস্টারের মত নতুন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলো এরপর ফের গবেষণাগারে শুরু করলো নতুন বিয়ে করার বিষয় নিয়ে শলাপরামর্শ রাহুল ততোক্ষণে মওলানাকে তাড়ানো এবং গবেষণাগার ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছে আঁড়ি পেতে শুনেছিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় নকশালরা এই মওলানাকে আটক করেছিল কী সব অভিযোগে তাকে মিলিটারির হাতে না দিয়ে নিজেরাই শাস্তি দিচ্ছিল প্রায় সপ্তাহখানেক আটক থাকার পর কৌশলে সে নকশাল ক্যাম্প থেকে পালিয়েছিল তারপর আর নকশাল বা মিলিটারিরা তাকে ধরতে পারেনি এরইমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে নকশালরা পালিয়ে গেছে রাহুল এই বিষয়কে ভিত্তি করেই পরিকল্পনা তৈরি করেছে

প্রস্তুতি শেষ, তখনই ওলোট-পালোট হয়ে গেল সব জানতে পারলো, ওকে খেতে-পরতে দেওয়ার খরচ দেওয়া সম্ভব নয় তাই গ্রামে কাজকর্মের জন্য এক বাড়িতে রাখার সবকিছু ঠিক করা হয়েছে সেখানে ওই বাড়ির চাকর-বাকরের কাজকর্ম করতে হবে তারা খেতে দেবে, পরনের কাপড়-চোপড়ও দেবে রাহুল জানতে পারলো, ওকে যে গহীন গ্রামে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে- সেটা রহমানের আত্মীয় বাড়ি

এটা ফাঁস হবার পর এক মুহূর্তের জন্যও সময় পেলো না রাহুল আহেদ আলী ওকে নিয়ে রওনা হলো রাহুল বুঝলো, নতুন কোন কুকর্ম করতেই পরিকল্পনা করা হয়েছে আর ওই মওলানা এতে উৎসাহ যুগিয়েছে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ দমানোর চেষ্টা করলো নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারায় ভেঙেও পড়লো কী হবে এখন? সব ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে কঠিন যন্ত্রণা নিয়ে চলতে হলো ওকে

কখনও বাসে, কখনও হেঁটে, আবার কখনও নৌকা আর সাইকেলে করে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো সেই বাড়িতে আহেদ আলী বাড়ি থেকে সাইকেল নিয়েই বেরিয়েছিল বাসের ছাদে তুলে তা গ্রামে নিয়ে এসেছে সারাদিন চলার পর সন্ধ্যে নাগাদ পৌছালো গন্তব্যে সারা রাস্তা ওকে ধর্মের ভাল ভাল কথা শুনতে হলো গন্তব্যে নিয়েও নামাজ পড়ানো হলো, মুরুব্বিদের পা ছুঁয়ে ছালাম করানো হলো তারপর ওকে আলাদা করে বাড়ির মালিকের সঙ্গে বৈঠক করলো আহেদ

রাতের বেলা ছোট একটা ঘরে বাড়ির এক ছেলের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হলোনামাজ পরিসএখানে যে কাজ করতে বলে তা ঠিকমত করিস ইত্যাদি বলেসুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লা বলতে বলতে আহেদ আলী চলে গেল আর যন্ত্রণায় নীল হওয়া চোখে ঝরঝর করে পানি ঝরতে লাগলো রাহুলের

 

------------ চলবে -------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for Message

ঢাকা থেকে মালদ্বীপ ভ্রমণ- ৩ [Dhaka to Maldives Travel-3]

  ঢাকা থেকে মালদ্বীপ ভ্রমণ - ৩ [Dhaka to Maldives Travel-3] ঢাকা থেকে মালদ্বীপ ভ্রমণ- ৩ [Dhaka to Maldives Travel-3] : কোথাও নীল কোথাও স...